রামকৃষ্ণের শেষ ছবি, ঘিরে দাঁড়িয়ে শিষ্যেরা

শরীর একটা নৌকা। প্রাণ তার মাঝি। যতক্ষণ মাঝি থাকে, নৌকা ভাসে। সংসার জলে সাঁতারের দিন ততক্ষণে পূর্ণ শ্রীরামকৃষ্ণের। ১৮৮৬-র ১৬ আগস্ট। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে এসে শ্রীরামকৃষ্ণের নাড়ি পরীক্ষা করে ভবলীলা সাঙ্গের খবর দিয়েছেন ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার।

বহু শিষ্যই খবর পেয়ে তাঁদের গুরু, কর্মবিধানদাতার নিথর দেহের সামনে উপস্থিত। ঘরটির বাইরে ক্রমশ অভ্যগ্রদের পায়ের শব্দ। কান্নার রোল। মনখারাপের মাতম। তখন বিকেল। পাঁচটার কাঁটা ছুঁইছুঁই। শিষ্যরা শ্রীরামকৃষ্ণের পার্থিব দেহ নামিয়ে আনেন। একটি খাটের উপর শোয়ানো হয় তাঁকে। এরপর তাঁর নিশ্চল অঙ্গ নতুন গেরুয়া পোশাকে সাজে শেষবার। চন্দন ও ফুলসজ্জায় শেষবারের মতো শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে বেশ ভিড় তখন।

ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার ততক্ষণে ছবি তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। এতদিন তাঁকে বকুনি দিয়ে চিকিৎসা করতেন। সেই তিনিই দিলেন ‘আদেশ’। ছবি তোলার জন্য দশ টাকা চাঁদাও দেন। তাঁর মহাসমাধির পর বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্স কোম্পানি আলোকচিত্র গ্রহণ করে। এ সম্পর্কে স্বামী অভেদানন্দ বর্ণনা করেছেন, ‘রামবাবু নিজে খাটের সম্মুখে দাঁড়াইয়া নরেন্দ্রনাথকে তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে বলিলেন। আমরা সকলে নির্বাক হইয়া সিঁড়ির ওপরে দাঁড়াইলাম। বেঙ্গল ফটোগ্রাফার কোম্পানি দুইখানা গ্রুপ ফটো তুলিয়া লইলেন।’ ছবিগুলো শ্রীরামকৃষ্ণের চতুর্থ ও পঞ্চম আলোকচিত্র। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত’ গ্রন্থে বৈকুণ্ঠনাথ সান্ন্যাল লিখছেন, ‘পরিতাপের বিষয়, অত্যধিক লম্বাবশত প্রাতঃকালের সে জ্যোতির্ময় ভাবটি তখন অস্তমিত হইয়াছিল।’ শংকর লিখলেন, ‘মঠ মিশনের কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক কারণেই এই ছবির প্রচারে কোনও দিন উৎসাহিত হননি।’ তবে এটাও ঠিক যে, এই দু’টি আলোকচিত্রের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশাল।

আরও পড়ুন
রামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনালেন তরুণ নরেন্দ্রনাথ, গুরুর মৃত্যুশোকেও সঙ্গী সেই গানই

ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার রোজনামচায় লিখছেন, ‘খাওয়াদাওয়ার পর প্রথমে ডাফ স্ট্রিটে যাই এক রোগিণীকে দেখতে, তারপর পরমহংসের কাছে। তিনি মৃত। গত রাত্রে একটার সময় তাঁর দেহাবসান হয়েছে, He was lying on the left side legs drawn up, eyes open, mouth partly open...।’ তাঁর চোখ ও মুখ খোলা। বাঁ-দিকে ফেরানো মাথা। ডান হাঁটু সামান্য তোলা। শেষকৃত্যের আগে তাঁর শিষ্যরা রামকৃষ্ণের শয্যার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে। যাঁদের শনাক্ত করা গিয়েছে, তাঁরা অতুলচন্দ্র ঘোষ, অমৃত, বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল, ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়, বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দ), নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), রামচন্দ্র দত্ত, গোপালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী অদ্বৈতানন্দ), শরৎ (স্বামী সারদানন্দ), বলরাম বসু, লাটু (স্বামী অদ্ভুতানন্দ), শশী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), নিত্যগোপাল বসু, যোগীন্দ্র (স্বামী যোগানন্দ), দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার, তারক (স্বামী শিবানন্দ), হুটকো গোপাল, নিত্যনিরঞ্জন (স্বামী নিরঞ্জনানন্দ), নারায়ণ, মণিলাল মল্লিক, ফকির, সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায়, হরিশচন্দ্র মুস্তাফি, গিরীন্দ্রনাথ মিত্র, বিনোদবিহারী ঘোষ, শ্রীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত), কালী (স্বামী অভেদানন্দ), নবগোপাল ঘোষ, গঙ্গাধর (স্বামী অখণ্ডানন্দ), মহিমাচরণ চক্রবর্তী, মনমোহন মিত্র। গুরুদশায় যেমন লাগে, শিষ্যদের শরীরে তেমনই পোশাক।

আরও পড়ুন
রামকৃষ্ণের জিভ চেপে ধরলেন মহেন্দ্রলাল, প্রশ্ন উঠল ‘পরমহংসগিরি’ নিয়েও

রামকৃষ্ণের সমাধির পর এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ যে, তিনি নাকি গঙ্গায় ডুবে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁরা অনেকেই পরমহংসের দেহ দাহের পক্ষে ছিলেন না। দাহকর্মের পর ভস্মাবশেষ দেখে বিবেকানন্দ যা বলেছিলেন, সে-কথা রয়েছে স্বামী অভেদানন্দের বর্ণনায়— ‘নরেন্দ্রনাথ বলিল, ‘দ্যাখো, আমাদের শরীরই শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবন্ত সমাধিস্থল। এসো, আমরা সকলে তাঁহার পবিত্র দেহের ভস্ম একটু করে খাই আর পবিত্র হই।’ নরেন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম কলসি হইতে সামান্য অস্থির গুঁড়া ও ভস্মগ্রহণ করিয়া ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলিয়া ভক্ষণ করিল।’’ কেশব সেনকে একবার শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘কেশব, তোমার ল্যাজ খসেছে।’ কথাটা শুনে কেশব সেনের অনুরাগীরা কেউ অবাক, কেউবা ক্রুদ্ধ। শ্রীরামকৃষ্ণের তখন ব্যাখ্যা— ‘যতদিন ব্যাঙাচির ল্যাজ থাকে, ততদিন সে জলেই থাকে। যেই ল্যাজ খসে, অমনি লাফ দিয়ে ডাঙাতে ওঠে। তখন সে জলেও থাকতে পারে, আবার ডাঙাতেও থাকতে পারে। তেমনি যতদিন মানুষের অবিদ্যারূপ ল্যাজ থাকে, ততদিন সে সংসার জলে থাকে। অবিদ্যার ল্যাজ খসলে জ্ঞান লাভ হলে, তবে মুক্ত হয়ে বেড়াতে পারবে, আবার ইচ্ছে করলে সংসারেও থাকতে পারে।’ অবিদ্যারূপ অন্ধকারের নিত্যনাশ করেছিলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।

তথ্যঋণ:
১. ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত’ - বৈকুণ্ঠনাথ সান্ন্যাল।
২. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত - শ্রীম।
৩.  শেষ দিনে খেলেন এক গ্লাস পায়েস - শংকর, আনন্দবাজার পত্রিকা

Powered by Froala Editor