‘এসবই ওঁর বুজরুকি’ – রামকৃষ্ণকে প্রথমবার দেখে বলেছিলেন গিরিশ ঘোষ

১৯১১ সাল। মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটক ‘বলিদান’। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মঞ্চে করুণাময়ের চরিত্রে অভিনয় করছেন ষাটোর্ধ এক পুরুষ। খালি গায়ে বারবার চলাফেরা করতে হচ্ছে তাঁকে। তাও অভিনয় করবেন তিনি। এটাই যে শেষ! যে মঞ্চ তাঁকে মহান করেছে, আজ তাকেই ছেড়ে যেতে হবে। হার মানতে শেখেননি যে! বাগবাজারের সিংহ তিনি, গিরিশ ঘোষ। এত সহজে শরীর তাঁকে হার মানাবে কী করে…

বাস্তবিকই ‘সিংহ’ তিনি। খোদ বাগবাজারে গিরিশ ঘোষের নামের এমনই জোর যে, তাঁর বাড়িও ভাঙার সাহস কেউ দেখাননি। রাস্তা তৈরি করতে হবে, করো। কিন্তু ওই হলুদ বাড়িটির গায়ে যেন আঁচড়টি না পড়ে। শেষে সবদিকই রক্ষা হল; গিরিশ ঘোষের বাড়ির দুই পাশ দিয়ে চলে গেল রাস্তা। অবশ্য এই নাম শুধু বাগবাজারে আবদ্ধ বললে অন্যায় নয়, অপরাধ হবে। গোটা বাংলা এবং অবশ্যই ভারতের সংস্কৃতির ইতিহাসে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান কী, সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

সওদাগরি অফিসের বুক-কিপার নীলকমল ঘোষ আর রাইমণি দেবীর অষ্টম সন্তান। পাঠশালায় পড়াকালীনই তাঁর ইচ্ছা হল কবি হওয়ার। কলম তুলে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন সেই বয়সেই। ইংরেজি, বাংলা- সমস্ত সাহিত্যের ময়দানই ঘুরে দেখেছেন তিনি। নিয়েছেন প্রয়োজনীয় রসটুকু। বাগবাজারের গিরিশের দৌরাত্ম্যের খবর তখন সব জায়গায় ঘুরত। সেই সঙ্গে বিখ্যাত হতে লাগল তাঁর মাতলামির কাহিনি। রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হয়েও এই স্বভাব যায়নি তাঁর। কিন্তু শুধু মদ দেখলেই হবে? বাংলা নাটককে জাতে তুলেছেন যিনি, তাঁর জীবন কি দেখলে না কেউ?

১৮৬৭ সাল। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের গীতিকার হিসেবে একটি নতুন নাম দেখল বঙ্গ থিয়েটার জগত। গিরিশ ঘোষের সেই প্রথম নাটকের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হল। এরপরে ‘সধবার একাদশী’তে তাঁর অভিনয় নজর কাড়ল সবার। একে একে নিজের জমি তৈরি করেছেন তিনি। প্রতিভা তো ছিলই, সেইসঙ্গে ছিল অমন ব্যক্তিত্ব। গিরিশ ঘোষের মুখে ওপর কথা বলার সাহস কেউ দেখাত না। আর হবে নাই বা কেন? ‘আবু হোসেন’, ‘চৈতন্যলীলা’, ‘প্রফুল্ল’, ‘মণিহরণ’, ‘সিরাজদ্দৌলা’— বাংলা সাক্ষী থেকেছিল একের পর এক সেরা নাটকের। অল্প সময়ই এইসব নাটকের স্ক্রিপ্ট, ডায়লগ লিখে ফেলতেন তিনি। ‘প্রফুল্ল’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। নিজে অভিনয় করছেন যোগেশের চরিত্রে। কিন্তু এর মধ্যেই যে মিনার্ভা’র জন্য নাটক লিখতে হবে! অভিনয় করে গ্রিনরুমে ফিরছেন, আর কলমচিকে লিখে নিতে বলছেন নাটকের সংলাপ। একই সঙ্গে চলছে দুটো কাজ। এই করেই তৈরি হল ‘মণিহরণ’।

গিরিশ ঘোষের প্রসঙ্গ এলে অবধারিত চলে আসবে আরও বেশ কয়েকজনের নাম। অমৃতলাল, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, আরও কত মান্যগণ্য ব্যক্তি। তবে সবার আগে বোধহয় থাকবেন দুইজন— নটী বিনোদিনী আর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। একজন প্রিয়তম শিষ্যা, আরেকজন গুরু। সেই সময়ের বাংলা রঙ্গমঞ্চে বিনোদিনী-গিরিশ ছিল কিংবদন্তি জুটি। দুজনের যুগলবন্দীতে একটার পর একটা নাটক উপহার পেতে লাগল দর্শক। বিনোদিনীর নিজের কথায়, “জোর জবরদস্তি, মান অভিমান, রাগ প্রায়ই চলত। তিনি আমায় অত্যাধিক আদর দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন।” জহুরির চোখ যে ঠিকই চিনে নিয়েছিল সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীকে। আর গিরিশবাবু? বিনোদিনীকে জোর গলায় বলেছিলেন, “তোমায় নিজের হাতে গড়ব। তুমি আমার সজীব প্রতিমা!” ১২ বছরের স্বল্প অভিনয় জীবনে বেশিরভাগ কাজই যে গিরিশবাবুর সঙ্গে। তিনিও বারবার বলতেন, তাঁর নাটকের এই যে এত খ্যাতি, তা সব বিনোদিনীর জন্য!

১৮৮৪-তে ‘চৈতন্যলীলা’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। নিমাইয়ের ভূমিকায় যেন নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে দিচ্ছেন বিনোদিনী। এদিকে দর্শকাসনে বসে সেই দৃশ্য দেখে বিহ্বল হচ্ছেন আরও একজন। শ্রী রামকৃষ্ণদেব। নাটক চলাকালীনই ভাবসমাধিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এর আগে গিরিশ ঘোষের যে ধর্মে কর্মে মতি ছিল, তা একেবারেই নয়। বরং তিনি ছিলেন কট্টর নাস্তিক। প্রথমবার রামকৃষ্ণকে যখন দেখেন, বলেছিলেন, ‘এ সব ওঁর বুজরুকি’। কিন্তু যত সময় যায়, ঠাকুরের আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন গিরিশ। বেহেড মাতাল গিরিশকে আঁকড়ে ধরেছিলেন রামকৃষ্ণ। তিনি কি জানতেন তাঁর মনের অবস্থার কথা?

আরও পড়ুন
দক্ষিণেশ্বরে যিশুপুজো করেছিলেন রামকৃষ্ণ, সেই রীতি মেনেই আজও বড়োদিন পালিত হয় মিশনে

একের পর এক মৃত্যু দেখেছেন কাছ দিয়ে। ছোটবেলায় দেখেছেন মা’কে চলে যেতে। একে একে বাবা, দাদা, বোনেদের মৃত্যুও ছুঁয়ে এগোচ্ছিলেন। সমস্ত কিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল, তখন স্ত্রী প্রমোদিনী চলে গেলেন। দ্বিতীয়া স্ত্রী’ও বাঁচলেন না বেশিদিন। কেন এত মৃত্যু? সমস্ত দরজা বন্ধ। শরীরও দুর্বল। শুধু কি মৃত্যু? একের পর এক আঘাত পেয়েছেন। গিরিশ ও নাট্যগোষ্ঠীর ওপর অভিমান করে অভিনয় জগত থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন বিনোদিনী। যাঁদের শিখিয়ে পড়িয়ে নাটক শেখালেন, তাঁদের হাতেই পরে অপমান সহ্য করতে হয় বৃদ্ধ সিংহকে। নিজের মাইনে থেকে টাকা পাঠাতেন দলকে। আর তাঁরাই কিনা এই প্রতিদান দিল? থিয়েটারকে একা হাতে বদলেছেন যিনি, তাঁকেই একটা সময় চলে যেতে বলা হল সেখান থেকে। এত অপমানের ভেতরেও একটা জায়গাতেই আশ্রয় পেতেন। দক্ষিণেশ্বর; ঠাকুরের কাছে।

১৯১২ সালে অবশেষে শান্ত হল বাগবাজারের প্রতাপশালী গিরিশ। একা সম্রাটের মতো মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন ‘বঙ্গের গ্যারিক’। আর হবে নাই বা কেন! নামটি যে তাঁর গিরিশচন্দ্র ঘোষ…

ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই’, ২০১৭
২) প্রথম আলো/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আরও পড়ুন
রামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনালেন তরুণ নরেন্দ্রনাথ, গুরুর মৃত্যুশোকেও সঙ্গী সেই গানই

Powered by Froala Editor