বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ঝকঝকে ৮৯, চ্যাপেল-বিতর্কে পাশে দাঁড়িয়েছেন সৌরভেরও

১৯৭৫-৭৬ সালের রঞ্জি ট্রফি। গ্রুপ পর্বে তিনটি ম্যাচ হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার সুযোগ আগেই হারিয়েছে পাঞ্জাব। তবুও এতটুকু দমেনি দলের মানসিকতা। গ্রুপের শীর্ষে থাকা উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে চতুর্থ ম্যাচেই বড়ো জয় পায় পাঞ্জাব। সেই ম্যাচে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে গোটা ক্রীড়ামহলের নজর কেড়ে নিয়েছিল অখ্যাত এক তরুণ তারকা। এমন নজরকাড়া পারফর্মেন্সের পরেও রঞ্জি ট্রফি থেকে বিদায়— কতটা হতাশাজনক, তা আর নতুন করে বলার মতো নয়। প্যাভিলিয়নে নিশ্চুপেই নিজের কিট গুছিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় ডাক এল তাঁর। দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন স্বয়ং বলিউডের ট্র্যাজিডি কিং দিলীপকুমার। আর সেই তরুণ তারকার পরিচয়?

তিনি আর কেউ নন, প্রথম বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্য যশপাল শর্মা। ক্রিকেট কেরিয়ারের শুরুতেই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতার আশিস কুড়িয়েছিলেন তিনি। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও দিলীপকুমারের অন্ধভক্ত ছিলেন যশপাল শর্মা। প্রিয় অভিনেতার মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই এবার তিনিও পাড়ি দিলেন পরলোকজগতে। গতকাল আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটারের। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে তাঁর এই বিদায় যেন মেনে নিতে পারছেন না ক্রীড়ামহলের কেউই।

১৯৫৪ সালে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্ম যশপালের। স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই ক্রিকেটের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। ক্রিকেটের ময়দানে নিজের জায়গা পাকা করে নিতে সময় লাগেনি খুব একটা। পাঞ্জাব স্কুলসের হয়ে একাধিক জাতীয় প্রতিযোগিতায় সেসময় ধারাবাহিকভাবেই খেলেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিরুদ্ধে স্কুলস লেভেল ফাইনালে ২৬০ রানের ঝকঝকে ইনিংস উপহার দেন যশপাল। আর তার পরেই সুযোগ আসে রাজ্য দলে খেলার।

রঞ্জি ছাড়াও সেসময় পাঞ্জাবের হয়ে দিলীপ ট্রফি, বিজয় হাজারে ট্রফিতেও খেলেছেন যশপাল। তাঁর ব্যাটিং-এ ভর করে ১৯৭৪ সালে বিজয় হাজারে ট্রফিতে চ্যাম্পিয়নও হয় উত্তরাঞ্চল। কিন্তু রঞ্জি তখনও অধরা তাঁর কাছে। ১৯৭৫ সালে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও সেবার ভাগ্য খুলে যায় তাঁর। সেদিন দর্শকাসনে ছিলেন অভিনেতা দিলীপকুমার। যশপালের ব্যাটিং-এ মুগ্ধ হয়ে তিনি নিজেই সাক্ষাৎ করেন তরুণ তারকার সঙ্গে। তিনিই তৎকালীন জাতীয় দলের নির্বাচক দুঙ্গারপুরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে জানান যশপালের কথা।

আরও পড়ুন
সৌরভ-ঋদ্ধিমানের সতীর্থ, অবসাদে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন এই বঙ্গ ক্রিকেটার!

তার ঠিক বছর দেড়েকের মধ্যেই জাতীয় দলের খেলার সুযোগ আসে যশপাল শর্মার। একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সেটা ১৯৭৮ সাল। তার পরের বছরই বিশ্বকাপ। হাতে গোনা কয়েকটি ম্যাচ খেলেই ’৭৯-এর বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে জায়গা করে নিলেন যশপাল। তবে দলে থাকলেও মাঠে নামার সুযোগ হল না তাঁর। সেই ঘটনাই যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর জেতার খিদে। 

আরও পড়ুন
ঘরোয়া ক্রিকেটে অসামান্য রেকর্ড, তবু ব্রাত্য ‘ভারতের ব্র্যাডম্যান’ কার্তিক বসু

’৭৯-এর বিশ্বকাপের পর ভারতীয় দলে মিডল অর্ডারে একপ্রকার নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন যশপাল। ওডিআই হোক কিংবা টেস্ট— মিডল অর্ডারে ভারতীয় দলের ভাগ্য যেন অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল তাঁর ওপর। তারপর ১৯৮৩-র ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ জয়। সেখানেও তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। প্রথম ম্যাচেই পাঁচ নম্বরে নেমে ৮৯ রানের ঝকঝকে ইনিংস দিয়ে যশপাল শুরু করেছিলেন বিশ্বকাপ অভিযান। দুরমুশ করে দিয়েছিলেন ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতাপান্বিত বোলিং লাইনকে। গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মাস্ট-উইন ম্যাচে এবং সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেও চালকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। 

আরও পড়ুন
৪৯ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক! আজও অক্ষত ১৮৭৭ সালের সেই রেকর্ড

বিশ্বকাপ জয়ের মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান যশপাল। সেটা ১৯৮৫ সাল। মাত্র ৭ বছরের ক্রিকেট কেরিয়ারে খেলেছেন ৪২টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও ৩৭টি টেস্টম্যাচ। ওয়ানডে-তে ৩১ ইনিংসে সংগ্রহ সংগ্রহ ৮৮৩ রান। টেস্টে ৩৭ ম্যাচে সংগ্রহ ১৬০৬ রান। পরিসংখ্যানের নিরিখে সংখ্যাটা হয়তো খুব বড়ো কিছু নয়। কিন্তু টালমাটাল পরিস্থিতিতে ভারতকে মূল্যবান জয় এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বিকল্প সেসময় ছিল না বললেই চলে। 

তবে খেলা থেকে সরে গেলেও, ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি যশপালের। হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁকে দেখা গিয়েছিল আম্পায়ারের ভূমিকাতেও। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিসিসিআই-এর নির্বাচক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন যশপাল। সেসময় ভারতীয় দলের কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। সেদিন নির্বাচক দলে যশপাল না থাকলে হয়তো অচিরেই শেষ হয়ে যেত সৌরভের ক্রিকেট কেরিয়ার।

বার বার চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে তাঁর ক্রিকেট জীবন। কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি সুদিন। তবে লড়াকু মেজাজই তাঁকে করে তুলেছিল দেশের সর্বকালীন সেরাদের একজন। ক্রিকেট কেরিয়ারের মতো ব্যক্তিগত জীবন থেকেও যে এত দ্রুত বিদায় নেবেন তিনি, তা কে-ই বা অনুমান করতে পেরেছিল? সে-কথাই যেন গতকাল ফিরে ফিরে আসছিল সতীর্থ কপিল দেবের কথাতেও। শুধু কপিলই নন, বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটারের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা ক্রিকেটমহল…

Powered by Froala Editor