সৌরভ-ঋদ্ধিমানের সতীর্থ, অবসাদে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন এই বঙ্গ ক্রিকেটার!

অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে নজরকাড়া পারফর্মেন্স, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে সেরে ক্রিকেটারের তকমা, ভিজি ট্রফিতে ডবল সেঞ্চুরি— যাকে বলে মণিমুক্তোখচিত কেরিয়ার। কিন্তু, এমন একজন মানুষকেই যদি প্যাভিলিয়নে বসে কাটাতে হয় প্রতিটা ম্যাচ? স্বাভাবিক নিয়মেই ঘিরে ধরবে হতাশা। ঠিক তেমনটাই হয়েছিল তাঁর ক্ষেত্রে। সুযোগ না পাওয়ার অবসাদ আর পারিবারিক অশান্তির জেরে শেষ পর্যন্ত চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। গলায় খালি করে দিয়েছিলেন অ্যাসিডের বোতল। ঝলসে যায় ভোকাল কর্ড। তারপর প্রায় দেড় মাস ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছিলেন তিনি হাসপাতালের শয্যায়। মৃত্যুসংশয়ের সঙ্গে চলেছিল অবিরত টানাপোড়েন। শেষ অবধি প্রাণ ফিরলেও চিরতরেই হারিয়ে যায় বাকশক্তি।

শুভজিৎ পাল। নামটা খানিকটা অচেনা ঠেকছে নিশ্চয়ই। তা লাগারই কথা, কারণ বিগত আট বছর ক্রিকেটজীবন, লাইমলাইট থেকে বহু দূরে একরকম অজ্ঞাতবাসেই রয়েছেন তিনি। অথচ, চলতি শতাব্দীর শুরুর দশকে বাংলার ক্রিকেটমহলে অন্যতম উদীয়মান প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান-উইকেটকিপার হিসাবেই ধরা হত তাঁকে। তবে নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের সেরা ফর্মে থাকাকালীন সময়েই তিনি শিকার হন ‘ক্রিকেট রাজনীতি’-র। পরিকল্পনামাফিক ভাবেই যেন সেসময় কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।

গল্পটা শুরু করা যাক একটু আগে থেকেই। ২০০২ সাল। অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফর। সে-দলে ছিলেন সুরেশ রায়না, অম্বাতি রায়ডু, ইরফান পাঠানের মতো তরুণ তারকা। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের সেই দল সাফল্য পেয়েছিল শুভজিতের চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং পারফর্মেন্সের ওপর ভর করেই। একমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড় হিসাবে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন তিনি। আর উইকেটকিপার হিসাবে ৩২টি শিকার। যাকে বলে স্বপ্নের উড়ান।

তবে, সেই সফরের পর রায়না কিংবা ইরফান পাঠান রঞ্জি ট্রফিতে রাজ্যের দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেও ব্রাত্য থেকে যান শুভজিৎ। অথচ, সেসময় বুরকেরি ভেঙ্কট রমন তাঁকে বাংলার দলের উইকেটকিপার হিসাবে চাইলেও, অনুমতি দেয়নি ক্রিকেট বোর্ড। বয়সের দোহাই দিয়ে সরিয়ে রাখা হয়েছিল টিম সিলেকশন থেকে। 

আরও পড়ুন
ম্যাকফি অ্যান্টিভাইরাসের স্রষ্টার আত্মহত্যা, নেপথ্যে কোন রহস্য?

রঞ্জিতে খেলার সুযোগ আসে আরও বছর কয়েক পরে। সৌরভের নেতৃত্বাধীন বাংলার হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে শুভজিতের অভিষেক হয় ইডেনে। বিপক্ষে তামিলনাড়ু। তবে সায় দেয়নি ভাগ্য। পর পর দুটি ইনিংসেই ব্যর্থ হন তিনি। সর্বসাকুল্যে সংগ্রহ মাত্র ৩ রান। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে খেলা সেই প্রথম, সেটাই যে শেষ ইনিংস হয়ে যাবে ক্রিকেট কেরিয়ারের— সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তাঁর। তবে হল তেমনটাই। গোটা টুর্নামেন্টে আর একটি ম্যাচেও প্রথম একাদশে জায়গা পেলেন না শুভজিৎ। আর রঞ্জি শেষ হওয়ার পর বাংলার দল থেকেই মুছে গেল তাঁর নাম। 

আরও পড়ুন
শূন্য থেকে খ্যাতি, ব্যর্থতা, আত্মহত্যার চেষ্টা - ‘বাবা কা ধাবা’-র মালিকের অমসৃণ জার্নি

অথচ, সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে স্বপ্নের পারফর্মেন্স মেলে ধরেছিলেন শুভজিৎ। তাঁর হাত ধরেই ৩২ বছর পর ভিজি ট্রফি ঢুকেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যাটে ঝলমলে দ্বিশতরানের ইনিংস। কিন্তু এতকিছুর পরেও উদাসীন ছিল ক্রিকেট বোর্ড। ফলত, ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছিল হতাশা, বিষণ্ণতা আর অবসাদ। আর একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিল শাণিত ব্যাটিং ফর্ম। অন্যদিকে ততদিনে বাংলায় নতুন উইকেটকিপার হিসাবে অভিষেক হয়েছে ঋদ্ধিমান সাহার। 

আরও পড়ুন
সিন্থেটিক ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল নাৎসি সেনারা, ‘নেশা’র অভাবেই আত্মহত্যা হিটলারের?

তবে সবটা ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ক্রিকেটের মূলস্রোতে ফেরার মরিয়া চেষ্টা করেন শুভজিৎ। সেখান থেকেই নাম লেখানো বিতর্কিত ক্রিকেট লিগ আইসিএল-এ। শেন বন্ডের মতো বিশ্বমানের বোলারের বিরুদ্ধেও অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন তিনি। কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি কিছুই। উল্টে অভিযোগ উঠেছিল তাঁর আচরণ নিয়ে। রাজ্য কিংবা জাতীয় দলের হয়ে খেলা সোনার পাথরবাটি হয়েই থাকে যায় তাঁর কাছে। তারপরই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন শুভজিৎ।

বিগত আট বছর একরকম অজ্ঞাতবাসেই চলে যান তিনি। আর ক্রিকেট? হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আর ময়দানমুখী হননি তিনি। বরং, প্রিয় খেলাটার প্রতিই জন্মে যায় এক প্রবল বিতৃষ্ণা। এমনকি আইপিএলের ন্যূনতম খবরাখবরও রাখেন না বাংলার একসময়ের সবথেকে প্রতিভাবান উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। ক্রিকেটের থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছে অভিমান। তবে এখনও নিজেকে সতেজ রাখতে ক্রমাগত শরীরচর্চা করে চলেছেন তিনি। সুযোগ এলে আবার ময়দানে ফিরতে চান শুভজিৎ। কোচিং করানোর জন্যেও অনুরোধ আসছে তাঁর কাছে। শুভজিৎ নিজেও আগ্রহী এই বিষয়ে। আর ময়দান অপেক্ষায় রয়েছে তার প্রাক্তন তারকাকে আবার ফিরে পাওয়ার জন্য…

তথ্যসূত্রঃ
সৌরভ, ইরফান, রায়নাদের সতীর্থ হতাশায় অ্যাসিড খেয়ে হারিয়েছেন বাকশক্তি, কাটাচ্ছেন নিঃসঙ্গ জীবন, এবিপি আনন্দ

Powered by Froala Editor