ম্যাকফি অ্যান্টিভাইরাসের স্রষ্টার আত্মহত্যা, নেপথ্যে কোন রহস্য?

১৯৮৭ সাল। সেসময়টায় ধীরে ধীরে বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা বাড়ছে কম্পিউটারের। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার কোম্পানি। ইন্টারনেটও চলে এসেছে সাধারণের হাতে। কিন্তু নিরাপত্তা? কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই ১৯৮৭ সালে প্রথম বাজারে এল অ্যান্টিভাইরাস। নেপথ্যে জার্মান সংস্থা জি ডেটা সফটওয়্যার। পিছিয়ে রইল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। তার কিছুদিনের মধ্যেই মার্কিন মুলুকে ‘ম্যাকাফি’ অ্যান্টিভাইরাস নিয়ে এলেন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা জন ম্যাকাফি। আর বছর কয়েকের মধ্যেই তাঁর সফটওয়্যার ফার্মের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ল গোটা বিশ্বে।

গতকাল প্রয়াত হলেন নিরাপত্তা প্রযুক্তির অন্যতম পথপ্রদর্শক জন ম্যাকাফি। মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। বুধবার বার্সেলোনার কাছে একটি কারাগারে ৭৫ বছর বয়সী এই মার্কিন ব্যবসায়ীর নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হন চিকিৎসকরা। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। কিন্তু হঠাৎ এমন আত্মহত্যার কারণ কী? আর এহেন ব্যক্তিত্বের হাজতবাসই বা কেন?

আসলে প্রযুক্তির জগতে ম্যাকাফির মতো খামখেয়ালি এবং একই সঙ্গে বিতর্কিত দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। আস্ত একটা অ্যান্টিভাইরাস কোম্পানি তৈরি করার পর, ২৫ বছরে ঠিক কতবার তিনি অফিসের পথে পা বাড়িয়েছেন— তা বলা যায় হাতে গুনেই। তবে টিকিয়ে রাখলেন না সেই ব্যবসাটুকুও। ২০১২ সালে হঠাৎই ‘ইন্টেল’-এর কাছে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলেন নিজের সংস্থা। তারপর? তারপর সরাসরি সম্মুখসমরে নেমেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে।

ব্যবসায় নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কিউবাকে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থদান করেন ম্যাকাফি। তবে অত্যন্ত গোপন এই ‘মানি ট্রান্সফার’ চোখ এড়ায়নি মার্কিন গোয়েন্দাদের। তাঁর নামে আদালতের মামলা দায়ের করে মার্কিন প্রশাসন। এরপর যেন আরও একধাপ এগিয়ে ২০১৪ সাল থেকে ম্যাকাফি বন্ধ করে দিলেন সরকারের কর দেওয়া। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোনোরকম আয়করই জমা দেননি তিনি। এর মাঝেই বিলাসবহুল জাহাজে করে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র চালানের অভিযোগে আরও এক মামলা দায়ের হয়েছে তাঁর নামে। সেই সঙ্গে তাঁর নাম জড়ায় গ্রেগরি ভিয়েন্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও। 

আরও পড়ুন
ব্র্যাডম্যানের খেলা দেখতে চেয়ে কারাগারে মহাত্মা গান্ধীর ছেলে!

২০১৯ সালে শেষ পর্যন্ত তাঁকে হাজিরা দিতে হল আদালতে। নিজেই সমস্ত দোষ স্বীকার করে নিলেন তিনি। প্রকাশ্য যুক্তি দিলেন, ব্যক্তিগত আদর্শের জন্যেই সরকারকে কর দেননি তিনি। আর এই ঔদ্ধত্যের জন্যই তাঁকে ৩০ বছরের কারাবাসের আদেশ দিয়েছিল মার্কিন আদালত।

আরও পড়ুন
একের পর এক খুন, জেল ভাঙার ‘কৃতিত্ব’; কেন আত্মসমর্পণ করলেন ‘বিকিনি কিলার’?

তবে মার্কিন পুলিশ কারাগারে পুরতে পারেনি তাঁকে। তার আগেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সপরিবারে চলে আসেন স্পেনে। বিগত দু’বছর সেখানেই একটা বিলাসবহুল জাহাজে স্ত্রী জেনিস, সাত সহকর্মী, দুই নিরাপত্তা কর্মী এবং চারটি পোষ্য সারমেয়কে নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন ম্যাকাফি। কিন্তু গতবছর অক্টোবরে বার্সেলোনা বিমানবন্দরে তাঁকে আটক করে স্পেনের পুলিশ। মার্কিন প্রদেশের আইন লঙ্ঘন করা ছাড়াও একাধিক প্রতারণার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। নিজের দেশে না হলেও, শেষ অবধি স্পেনে এসেই হাজতের মুখ দেখতে হয় প্রযুক্তিবিদকে।

আরও পড়ুন
অনলাইনে ক্লাস করবে বোন, কারাগারে উপার্জিত অর্থ দিয়েই স্মার্টফোন উপহার দাদার

তবে তাতে খুব একটা আপত্তি ছিল না ম্যাকাফির। এমনকি স্পেনের কারাগারের সম্পর্কে বেশ ভালো কথাই শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। অল্পদিনের মধ্যেই সেখানকার নিরাপত্তাকর্মী এবং অন্যান্য অপরাধীদের সঙ্গে জমে উঠেছিল বন্ধুত্ব। অনেকেই চিনতে পেরেছিলেন তাঁকে। ফলে অটোগ্রাফ নেওয়ার লাইন লেগে থাকত রোজই। জেলের মধ্যেই প্রায় তারকা হয়ে উঠেছিলেন ম্যাকাফি। এমনকি আদালতের শেষ শুনানিতেও তিনি বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে চান না তিনি, বরং স্পেনের জেলেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। 

কিন্তু তা আর হল কই? গত মঙ্গলবারই স্প্যানিশ আদালত রায় দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হবে তাঁকে। সেইমতো প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল সমস্ত আইনি কার্যকলাপও। তবে পরের দিনই আত্মহননের পথকে বেছে নেন জন। 

দেশে ফেরার ব্যাপারে এতটাই অনীহা ছিল তাঁর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন একজন ব্যক্তিত্বই দু-দু’বার সামিল হয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে। আবার আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া মুহূর্তই কাটত না তাঁর। এমনকি দু’হাতে পিস্তল নিয়ে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে বিতর্কের ঝড়ও তুলেছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে এককথায় এক বর্ণময় চরিত্র। যাঁর গোটা জীবনটাই এলোপাথাড়ি, হিসেবহীন, অপ্রত্যাশিত। চলে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সেই অদ্ভুত চরিত্রটাকেই যেন ধরে রাখলেন তিনি। একরাশ রহস্য আর প্রশ্ন রেখে গেলেন বার্সেলোনার ছোট্ট কারাগারে। যার উত্তর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনোদিনই…

Powered by Froala Editor