গবেষণার জন্য ফিরিয়েছিলেন লোভনীয় চাকরি, প্রয়াত কিংবদন্তি মহাকাশবিজ্ঞানী রোদ্দাম নরসিমহা

মহাকাশবিদ্যায় এগিয়ে থাকা দেশগুলির মধ্যে অন্যতম ভারতে। তবে এই জায়গায় পৌঁছনো হয়তো সম্ভব হত না ষাট-সত্তরের দশকে কিছু বিশেষ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছাড়া। তাঁদের মধ্যেই অন্যতম একজন বিজ্ঞানী রোদ্দাম নরসিমহা। সোমবার সন্ধ্যায় কিংবদন্তি এই মহাকাশবিজ্ঞানীর মৃত্যু হল বেঙ্গালুরুর এক বেসরকারি হাসপাতালে। হৃদযন্ত্রজনিত সমস্যা ছিল আগে থেকেই। বছর দুয়েক আগে ব্রেন-স্ট্রোকেও আক্রান্ত হন কিংবদন্তি গবেষক। গত ৮ ডিসেম্বর মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। তবে ফিরে আসা হল না আর। ৮৭ বছর বয়সেই থেমে গেল লড়াই।

১৯৩৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার ছোট্ট একটি গ্রামে জন্ম রোদ্দাম নরসিমহার। বাবা ছিলেন ব্যাঙ্গালোরের সেন্ট্রাল কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ফলে বড় হয়ে ওঠা সেখানেই। মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত বেঙ্গালুরুর বিশ্বেশ্বর কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। স্নাতকতা করার সময় টাটা ইনস্টিটিউটে (বর্তমান আইআইএস বেঙ্গালুরু) স্পিটফায়ার এয়ারক্রাফটের একটি সেমিনারে অংশ নেওয়ার পর তিনি আকর্ষিত হন স্পেসক্রাফট টেকনোলজিতে। পরবর্তীকালে স্নাতকোত্তর করার সময় অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল বিভাগে যোগ দেন তিনি।

১৯৫৫ সালে এসেছিল ভারতীয় রেল এবং বার্মা শেলে চাকরি করার সুবর্ণ সুযোগ। তবে বাড়ির সকল আত্মীয়-পরিজনের অমতে গিয়েই তিনি কাজ শুরু করেন কিংবদন্তি মহাকাশ বিজ্ঞানী সতীশ ধাওয়ানের সঙ্গে। পরবর্তীতে যিনি নিযুক্ত হন ইসরোর চেয়ারম্যান হিসাবে। সতীশ ধাওয়ানের উদ্যোগেই ১৯৬১ সালে আমেরিকায় যাত্রা করেন রোদ্দাম নরসিমহা। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে এরোটেকনোলজি নিয়ে ডক্টরেট করেন হান্স লিপম্যানের অধীনে। 

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসেছে ১৯৬২ সালে অধ্যাপক হিসাবে তিনি যোগ দেন আইআইএস বেঙ্গালুরুতে। ১৯৯৯ সাল অবধি সেখানেই অধ্যাপনা করেছেন তিনি। পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন গবেষণাও। মহাকাশযানের ক্ষেত্রে ফ্লুইড ডায়নামিক্স জনিত সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেন তিনি। অশান্ত প্রবাহের দরুন উৎপত্তি শকওয়েভের বিশ্লেষণ এবং বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরে প্রবাহীর অশান্ত প্রবাহের প্রেক্ষিতে প্রযুক্তি এবং উপযুক্ত নীতিনির্ধারণ করেন তিনি। বায়ুমণ্ডলীয় বাধা অতিক্রম করার জন্য মহাকাশযানে প্রণয়ন করেন নতুন প্রযুক্তির।

১৯৮২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিরিক সায়েন্সের। উল্লেখ্য, তার আগে সেইভাবে বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানের জন্য বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না ভারতে। ১৯৮৯ সাল অবধি সেখানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। পাশাপাশি ন্যাশনাল এরোস্পেশ ল্যাবরেটরি (ন্যাল)-এ ডিরেক্টরের দায়িত্বও পালন করেন রোদ্দাক নরসিমহা। তাছাড়াও ‘হ্যাল’-এর পরিচালক সমিতি এবং রাজীব গান্ধীর সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসারি কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্ডিয়ান স্পেস কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।

সব মিলিয়ে প্রায় ২০০-র বেশি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন রোদ্দাম। লিখেছেন ১৫টি বই। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মিশাইল ম্যান এপিজে আব্দুল কালামের সঙ্গে লিখেছেন ‘ফ্লুইড মেকানিক্স অ্যান্ড স্পেস টেকনোলজি ডেভলপমেন্টস’। ১৯৮৭ সালে তিনি সম্মানিত হন পদ্মভূষণ সম্মানে। ২০০০ সালে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ এরোনটিক্স এন্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্স থেকে ফ্লুইড ডাইনামিক্স পুরস্কার পান রোদ্দান নরসিমহা। পাশাপাশি একই প্রতিষ্ঠানে সাম্মানিক সদস্যপদও দেওয়া হয় তাঁকে। ২০১৩ সালে জোটে পদ্ম বিভূষণ সম্মাননাও। তাছাড়াও পেয়েছেন ভাটনগর পুরস্কার, গুরজামাল মোদি পুরস্কার, ক্যালটেক সম্মাননা প্রভৃতি— যে তালিকা শেষ হওয়ার নয় সহজে।

আরও পড়ুন
সুধীরবাবু পেলে হয়তো সুবিচার করতেন সেসব গানের সঙ্গেও

চলতি বছরের শুরুর থেকেই একের পর এক নক্ষত্রপতন হয়ে চলেছে। সাহিত্য, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে বিনোদন সমস্ত ক্ষেত্রেই যেন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বদের হারাচ্ছে ভারত। মহাকাশবিজ্ঞান দিকপাল রোদ্দাম নরসিমহার মৃত্যু আরও একবার শোকস্তব্ধ করে দিল ভারতের বিজ্ঞান-মহলকে। শেষ বয়সে অধ্যাপনা কিংবা গবেষণার কাজে যুক্ত না থাকলেও, অভিভাবক হিসাবেই পথ দেখিয়েছেন তিনি। চন্দ্রযান ২-এর চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করে ইসরোতে নিজের অভিমত প্রকাশ করেছিলেন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। সেই জায়গাটা শূন্য হয়ে গেল হঠাৎ করেই। তাঁর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। ভারতীয় মহাকাশবিজ্ঞানের একটি অধ্যায় শেষ হল নিশ্চুপেই...

Powered by Froala Editor