সুধীরবাবু পেলে হয়তো সুবিচার করতেন সেসব গানের সঙ্গেও

ক’দিন আগেই তাঁর সঙ্গে ঘুরে এসেছি দাতাবাবার মেলায়। গিয়েছি শান্তিপুরে, রাস উৎসব দেখতে। কাটোয়ার কার্তিকের লড়াই, অগ্রদ্বীপের মেলা, ঘোষপাড়ায় ঢুঁ – সঙ্গী হতে মানা কই! তিনিই তো শিখিয়েছেন, জানার জন্য চলায় বাধা নেই। না, তিনি প্রথম না, তাঁর আগে মন্ত্র নিয়েছি কালকূটের কাছে। মাদক সেই ভবঘুরেপনাই নাগরিক ছোঁয়া পেল সুধীর চক্রবর্তীর কাছে। স্থির হয়ে, আবেগ সরিয়ে ভাবা। শব্দে, গানে, লোকাচারে খুঁজে বেড়ানো বাংলার আবহমান রসের ধারা। তাঁর প্রয়াণ কি আমার কাছে মহাগুরুনিপাত?

আমি কৃষ্ণনাগরিক নই। আলাপ তো দূরের কথা, সাক্ষাৎও হয়নি কখনও। ‘স্যার’ বলে সম্বোধনের প্রয়োজনও বোধ করিনি। দরকারই বা কী! মনে-মনে নাড়া বেঁধেছিলাম। পড়তে-পড়তে শেখা, শিখতে শিখতে চলার সেই পথ ফুরনোর নয়। পাঠকের সঙ্গে লেখকের এই যে সম্পর্ক, এর চেয়ে বড়ো কোনো আত্মীয়তা হতে পারে?

রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দিলীপকুমার রায় প্রমুখের ওপর তাঁর রচনা শিরোধার্য। এককথায়, আধুনিক বাংলা গান সম্পর্কে তিনি একজন অথরিটি। তাঁর পাণ্ডিত্যকে প্রণাম জানাই। কিন্তু যে সুধীর চক্রবর্তী ঘুরে বেড়ান বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে, কুবির গোঁসাই-এর খাতা হাতে নিয়ে লিখে নেন হারাতে-চলা গান, সতীমার মেলায় ‘ভাবের গীত’ শুনে মোহান্তের সঙ্গে আলাপ করেন দুলালচাঁদের সম্পর্কে, তাঁকে ছিন্ন করি এমন সাধ্য নেই।

অশোক মিত্রের ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা’ সংকলনের কাজ শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। তারপর অজস্র উত্থান-পতন। কত মেলা হারিয়েছে, কিছু আবার ধুঁকছে। সুধীরবাবুর বই আমার কাছে হয়ে উঠেছিল সেসবেরই সাম্প্রতিক দলিল। পরবর্তীকালে লোক-গবেষক সোমব্রত সরকার ও সুমনকুমার দাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে জেনেছি আরও সুলুকসন্ধান। না, গিয়ে পৌঁছতে পারিনি প্রায় কোথাওই। তবু যখন বেড়াচাঁপায় পৌঁছে হাড়োয়ায় যেতে মন উসখুস করে, খুঁজে বেড়াই গোরাচাঁদ পীরের সমাধি, মনে-মনে কি সুধীরবাবুই ছড়ি ঘোরান? কিংবা আগরপাড়ার তারাশাহের দরগায়? 

ঘোষপাড়া শ্মশানে দোলের আগের রাতে একবার আলাপ হয়েছিল এক তান্ত্রিকের সঙ্গে। না, তিনি সুধীরবাবুকে চেনেন না। অথচ তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় আমার প্রচ্ছন্নে কি সুধীর চক্রবর্তীই নেই? কিংবা সুদূর বাংলাদেশের সুনামহগঞ্জে, শাহ আবদুল করিমের ভিটেয়? সুধীর চক্রবর্তী হাওর অঞ্চলের বাউল-ফকিরদের নিয়ে সেভাবে লেখেননি কোনোদিনই। অথচ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নূরজালালের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, কিংবা রণেশ ঠাকুরের কাছে উজানধল নদীর তীরে বসে শুনছিলাম চেনা গানের অচেনা সুর, মনে হয়েছিল সুধীরবাবুকে শোনাব কোনোদিন। সুষমা দাসের পায়ের কাছে বসে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম হাওরের গান। সুবিচার করতে পারিনি সেসবের। সুধীরবাবু পেলে হয়তো...

আমাকে বাহিরের নেশা ধরালেন কালকূট, লোকায়তের মৌজ দিলেন সুধীর চক্রবর্তী। কালকূট আমার জন্মের আগেই প্রয়াত। সুধীরবাবু ছিলেন এতদিন। আজ চলে গেলেন তিনিও। কিন্তু এ-যাওয়ায় শোক নেই। যা দিয়ে গিয়েছেন, কণামাত্রও যদি জমিয়ে রাখতে পারি, সেই-ই হবে প্রকৃত গুরুদক্ষিণা। কেননা তিনিই তো সংগ্রহ করেছেন –

আরও পড়ুন
বেজে উঠল রেকর্ড, রাস্তার ধারেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ সুধীর চক্রবর্তীর

“প্রকৃতি স্বভাব না নিলে হবে না গুরুভজন।
আগে স্বভাবকে করো প্রকৃতি
গুরুকে পতি স্বীকৃতি।
তবে হবে আসল করণ।।”

এই প্রগাঢ় নাগরিক জীবনে, দিনান্তের সমস্ত ক্লান্তি দূর করতে পারে এই সাধনাই। ষটচক্র ভেদ করে, ধারা-কে রাধারূপ দিয়ে আজ্ঞাচক্রে প্রকাশ। মন্ত্রতন্ত্র জানিনে। শ্বাসের খেলাও অজানা। ঘটনাটুকু চিনিয়েছিলেন সুধীরবাবু। বাহির ও ভিতরে এই খোঁজের জীবনে, সেই চেনানোই হোক গুরুমন্ত্র। বাকি সব জীবনস্রোতেই...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ছুটি নিলেন জীবন থেকে, ‘গভীর নির্জন পথে’-র উদ্দেশে সুধীর চক্রবর্তী