বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি, পরে নিজেই নিখোঁজ হয়ে গেলেন জহির রায়হান

১৯৭২ সালের ২৮ জানুয়ারি। এক মাস আগেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করতে পেরেছে মুক্তিযোদ্ধারা, পেরেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা এসেছে বটে; কিন্তু তখনও দেশের ভেতর লুকিয়ে আছে হানাদাররা। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেককেই ‘গুম’ করেছে ওরা। সেরকমই একজন ছিলেন প্রখ্যাত লেখক শহীদুল্লাহ কায়সার। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ তাঁকে চিরকালের জন্য নিখোঁজ করে দিয়েছে। এমন সময় ’৭২ সালের ওই দিনটিতে ফোন বেজে ওঠে বাড়িতে। ওপারে এক ব্যক্তি খবর দিল যে, শহীদুল্লাহ কায়সারকে নাকি মিরপুরে আটক করে রাখা হয়েছে। শুনে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরোলেন ওঁর ভাই, লেখক-পরিচালক জহির রায়হান। সেই শেষবার; এরপর আর কেউ দেখেনি জহির রায়হানকে…

ডিসেম্বর মাস বাংলাদেশের সংগ্রামের মাস। অজস্র বাঙালি তরুণ, নারী, বৃদ্ধের লড়াইয়ের মাস। এসবের ভিড়ে উঠে আসে একের পর এক নাম; যাঁদের সৃষ্টি সেই সময়ের মানুষদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। সেই আগুনের পরিবেশেও বাঁচিয়ে রেখেছিল নতুন ভোরের আশায়। সেরকমই একজন মানুষ হলেন জহির রায়হান। অবশ্য এই পরিচয়টা দিলেই সম্পূর্ণটা বলা হয় না। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক ইতিহাসে জহির রায়হান একজন কিংবদন্তি। যার হাত ধরে গোটা বিশ্ব দেখেছিল একটি দেশের সংগ্রাম, মানুষের দুর্দশা। আর তাঁকেই কিনা অচিরে হারিয়ে যেতে হয়েছিল। আর কোনদিনও তাঁকে দেখা যায়নি, হদিশও মেলেনি… 

জহির রায়হান যখন জন্মেছিলেন, তখন দেশ ছিল অখণ্ড। মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে ইংরেজ। বাবা ছিলেন কলকাতার এক মাদ্রাসা শিক্ষক। শৈশবের একটা সময় এই শহরের বুকেই কাটিয়েছিলেন জহির। দেখেছেন স্বাধীনতার লড়াই, দেখেছেন কীভাবে কবিতা-গল্প-নাটকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কথা উঠে আসছে। আর দেখেছেন নিজের দাদা, শহীদুল্লাহ কায়সারকে। ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে রাজনৈতিক চেতনা, বেড়ে ওঠে সাহিত্যচর্চা। 

চলচ্চিত্র নয়, প্রথমে সাহিত্যই হাত ধরেছিল জহির রায়হানের। ১৯৫২ সাল। ইংরেজ শাসন শেষ হয়েছে বটে; কিন্তু ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে অখণ্ড ভারতরাষ্ট্র। পূর্ব বাংলার তখন পরিচয় পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে। এমন একটি দেশ, যেখানে বাংলার স্থান নেই, বাঙালির মর্যাদা নেই। এ তো হতে পারে না! সুতরাং শুরু হল ভাষা আন্দোলন। বাকি গল্পটা এক ঐতিহাসিক আখ্যানে পরিণত হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় গুলি চলা, তরুণ বাঙালির রক্তে ধুয়ে যাওয়া বাংলা ভাষা— এ এক নতুন মোড়। আর সেই মোড়েই দাঁড়িয়েছিলেন জহির রায়হানও। ’৫২-এর আমতলা মিটিংয়েও উপস্থিত ছিলেন তিনি। এমন সময় সেখানে হাজির হল পাকিস্তানি পুলিশ। সবাইকে ধরে কারাগারের অন্ধকারে নিক্ষেপ করল।

আর এই ঘটনাই জন্ম দিল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ জহির রায়হানের। তিনি বন্দুক হাতে যুদ্ধে নামেননি; কিন্তু নিজের সৃষ্টি, কলম আর ক্যামেরাকে অস্ত্র করে নিয়েছিলেন। ’৫২ সালে জেলের ভেতর বসেই লেখেন ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাস, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এক সৃষ্টি। একের পর এক গল্প, উপন্যাসের জন্ম দিতে লাগলেন তিনি। প্রায় সবকটাতেই ছুঁয়ে যেতে লাগল বাংলার রূপ, তখনকার পরিবেশ, যুদ্ধ, বঞ্চনা। ‘হাজার বছর ধরে’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘কয়েকটি মৃত্যু’, ‘সূর্যগ্রহণ’… তালিকা দীর্ঘ। তবে এখানেই শেষ নয়। ছাত্রাবস্থাতেই নাট্যজগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। কলমের পাশাপাশি ক্যামেরাও যে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে তাঁর! 

সিনেমার আঙিনায় তিনি এক প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। বাংলাদেশের সিনেমায় জহির রায়হান নিয়ে এলেন এক নতুন ঢেউ। চিত্রনাট্য থেকে নির্মাণ— সব জায়গায় ছুঁয়ে গেল মৌলিকতা। ১৯৬১ সালে মুক্তি পেল প্রথম ছবি ‘কখনো আসেনি’। বস্তুত, প্রথম সিনেমা থেকেই বোঝা গেল জহির রায়মানের স্বকীয়তা। ঠিক তিন বছর পর তৈরি করেন ‘সংগম’; যা উপমহাদেশের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। ধরা যাক ‘কাঁচের দেয়াল’-এর কথা। এটি বাংলাদেশের প্রথম ছবি, যেখানে সম্পূর্ণ অর্থেই মেয়েদের কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে নারীবাদের কথা। ১৯৬৫ সালে এই ছবিই জিতে নেয় পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলি। নিজের মতো করেই বাংলাদেশের সিনেমার আধুনিক মানচিত্রটি তৈরি করতে শুরু করেছিলেন জহির রায়হান। 

আরও পড়ুন
শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ নয়; আফ্রিকার এই দেশটিরও সরকারি ভাষা বাংলা

এসবের বাইরে গিয়েও তখন সমাজ ফুটছে মুক্তির সংগ্রামে। ধীরে ধীরে কাছে আসছে সত্তরের দশক। গোটা পৃথিবীতেই চলছে নানা অভ্যুত্থান। একদিকে ভিয়েতনামের ঘটনা, আমেরিকায় বিক্ষোভ, প্যারিসের রাস্তায় মিছিল, ফিদেল কাস্ত্রো-চে গুয়েভারা— সমস্ত চালচিত্রের মধ্যেই ফুটে উঠছিল পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ। এবং এই পরিস্থিতিতে আবারও জন্ম হল নতুন এক জহির রায়হানের। অবশ্য একে ঠিক নতুন বলা যায় না; সেই ’৫২ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর তিনি। সেই স্বপ্নই ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে, নিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে। পাকিস্তান সেনা, সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক লেখা প্রকাশ করতে লাগলেন। ১৯৫২ থেকে যে নির্যাতনের ইতিহাস নেমে এসেছে বাংলার ওপর, তার শেষ দেখে ছাড়বেন সবাই। 

১৯৬৯ সাল। কয়েক মাস পরেই নতুন দশক শুরু হবে। জহির রায়হান ঠিক করলেন, পূর্ব পাকিস্তানের এই সংগ্রামের ছবিটা তুলে ধরবেন সিনেমার পর্দায়। আমজাদ হোসেনের সঙ্গে চিত্রনাট্য তৈরি করতে লাগলেন তিনি। কাহিনিটি একটি পরিবারের। তার সদস্য, সংসার, চাবির গোছার সঙ্গে বেড়ে উঠল একটি দেশ। ‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন, একটি চলচ্চিত্র’… প্রথমে সিনেমাটির নাম দেওয়া হল ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’। জহির রায়হান পরে নিজেই বদলে দিলেন নাম; জন্ম নিল ‘জীবন থেকে নেয়া’। তাঁর নিজের তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকল এই ছবি। এটা স্রেফ রিল আর অভিনয় নয়; ‘জীবন থেকে নেয়া’ হয়ে উঠল একটি আস্ত আখ্যান। স্বাধীনতার আখ্যান, যেখানে এসে মুগ্ধ হলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকদের মতো পরিচালকরাও… 

স্বাভাবিকভাবেই এরপর পাকিস্তানি সেনাদের বিষনজরে পড়েন জহির রায়হান। অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন তিনি। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় তিনি চলে গেলেন কলকাতা। সেখানে শুরু করলেন প্রচার অভিযান। গোটা কলকাতায় গণজাগরণ তৈরি করলেন তিনি। জহির রায়হানের রক্ত তখন ফুটছে টগবগিয়ে। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও লেখালেখি করে যা অর্থ আসছে, সব তিনি দান করছেন মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে। কিন্তু এরকমভাবে একটি শহরেই প্রচারকাজ চালালে হবে না। বিশ্বব্যাপী আন্দোলন করতে হবে; বাংলার কথা, বাংলাদেশ নামক স্বপ্নের কথা, হানাদারদের বর্বরতার কথা পৌঁছে দিতে হবে। ঠিক করলেন, এখানেও হাতিয়ার করবেন ক্যামেরাকে। তখন পাকিস্তানি সেনারাও মিথ্যা প্রচার শুরু করেছে। যে করেই হোক, বাঙালি বুদ্ধি, মেধার টুঁটি চেপে ধরতে হবে। সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখতে হবে। আর এসবের বিরুদ্ধেই ক্যামেরা হাতে নেমে পড়লেন জহির রায়হান। একাই যেন সৈনিক! ওই সময় বাঙালিদের অবস্থা কীরকম, কেমন অত্যাচার চলছে সেই সবটা তিনি ধরে রাখলেন রিলে। মুক্তি পেল তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। এই প্রথম বিশ্বের সামনে উঠে এল পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা। বিশ্ব শিউরে উঠল হানাদারদের বর্বরতা দেখে। মুক্তিযুদ্ধের এক দলিল হয়ে রইল এই প্রামাণ্যচিত্র, অমর হয়ে রইলেন জহির রায়হান… 

আরও পড়ুন
পাঁচতারা হোটেলের জন্য জমিদখল, প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী ‘ম্রো’-রা

এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়েছে বুদ্ধিজীবী নিধন। অন্ধকারে অপহরণ করা হল কবি, লেখক, শিল্পী, মুক্তমনা মানুষদের। এই তালিকাতেই পড়লেন জহির রায়হানের দাদা শহীদুল্লাহ কায়সার। নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। পরে বাকি বুদ্ধিজীবীদের দেহ পাওয়া গেলেও, শহীদুল্লাহের কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। এমন আবহেই আকাশে উঠল নতুন সূর্য। হাজার হাজার রক্তের বিন্দুর ভেতর জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশে ফিরে এলেন জহির রায়হান। আনন্দিত তিনি, উল্লসিত। কিন্তু সেই আনন্দ বদলে গেল বেদনায়, যখন জানতে পারলেন তাঁর দাদার নিখোঁজ হওয়ার কাহিনি। সেই দাদা, যার হাত ধরে শিল্পজগতের সঙ্গে পরিচয়। যার হাত ধরে ‘জহির রায়হান’ হয়ে ওঠা… 

কাজেই, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যখন সেই রহস্যময় ফোনটি বেজে উঠল তাঁর বাড়িতে, আর স্থির থাকতে পারেননি। কে জানত, সেটা ছিল একটা ছক! কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সেই মুহূর্তে মিরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন জহির রায়হান। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়স তাঁর। সেটাই শেষ দেখা। ’৭২-এর ৩০ জানুয়ারির পর আর কোথাও তাঁর হদিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি, মৃত অবস্থাতেও নয়। বলা ভালো, সেই সময়ও মিরপুরের বুকে গা ঢাকা দিয়ে ছিল অনেক হানাদার। ছদ্মবেশে থেকে হামলার ছক করত; আর তাদের সহায় হত স্থানীয় বিহারীরা। সেরকমই কারোর হাতে… সেটাই ধরেছিলেন সবাই। সেই জানুয়ারি থেকেই নিখোঁজ এবং নিহত হলেন জহির রায়হান। 

কাহিনি শেষ করা যাক ১৯৯৯ সালের একটি ঘটনা দিয়ে। মিরপুরের ১২ নং সেকশনের মুসলিম বাজার এলাকায় নতুন মসজিদ তৈরি হবে। সেইসময় ওখানে মাটি কাটা হচ্ছিল। হঠাৎই মাটির ভেতর থেকে উঠে এল মানুষের কঙ্কাল, গুলিবিদ্ধ হাড়, করোটি। তাহলে কি এই জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ চাপা দেওয়া হয়েছিল? হঠাৎ আরও একটি বিষয় মাথায় খেলে গেল। মনে পড়ে গেল জহির রায়হানের কাছে আসা সেই ফোনকলটির কথা। বলা হয়েছিল, এই ১২ নং সেকশনেই নাকি বন্দি করে রাখা হয়েছে শহীদুল্লাহ কায়সারকে। কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে এইখানেই এসেছিলেন জহির রায়হান। তাহলে কি… 

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের তথ্যচিত্র, দেখুন সেই দুষ্প্রাপ্য দলিল

জানা গেল, ১৯৭২-এর ওইদিন সত্যি সত্যি গুলির লড়াই শুরু হয়েছিল এখানে। এবং এখানে উপস্থিত ছিলেন জহিরও। পরবর্তীকালে সেই হামলায় বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তির কথা অনুযায়ী, গুলির লড়াইয়েই নাকি প্রাণ হারান জহির রায়হান। তারপর তাঁর দেহ কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, কেউ জানে না। জহিরের মতো মানুষরা এভাবেই কাজ করে যান। তাঁদের কখনও খুঁজে পাওয়া যায় না। অলক্ষ্যে থেকে কেবল কাজগুলো করে যান। ফিনিক্স পাখি হয়ে চলে আসেন আমাদের সামনে। হানাদারদের পৈশাচিক গুলি তাঁর প্রাণ কেড়ে নিলেও, তাঁর সৃষ্টি মুছে দিতে পারবে কি? দেহ লোপাট করা যেতে পারে; আত্মা লোপাট করা যায় কি? 

তথ্যসূত্র-
১) ‘জহির রায়হান: নিখোঁজ ও অপেক্ষার হাজার বছর’, সহুল আহমদ, বিডি নিউজ ২৪
২) ‘জহির রায়হান: বড় ভাইকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেলেন চিরতরে’, রাকিব হাসান ওয়েশি, রোর বাংলা
৩) ‘জীবনের জয়গান ও জহির রায়হান’, পিয়াস মজিদ, প্রথম আলো 

Powered by Froala Editor

More From Author See More