পাঁচতারা হোটেলের জন্য জমিদখল, প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী ‘ম্রো’-রা

বাংলাদেশের ছবির মতো পাহাড়ে ঘেরা অঞ্চল বান্দরবন। সেখানেই রয়েছে পর্যটকদের অন্যতম দুই আকর্ষণ— নীলগিরি আর মাউন্টেন অফ মুন বা চাঁদের পাহাড়। বছরের পর বছর ধরেই এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন স্থানীর ‘ম্রো’-উপজাতি। কিন্তু পর্যটন শিল্প আর ‘উন্নয়ন’-এর ঠেলায় বাস্তুচ্যুত হতে বসেছেন পাহাড়িজমির ভূমিপুত্ররাই। রবিবার তার প্রতিবাদেই সমবেত হয়ে রাস্তায় নামলেন ম্রো-উপজাতির মানুষেরা।

উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা। আর তার জন্যই প্রয়োজন পড়েছিল ঝাঁ-চকচকে বিলাসী হোটেলের। পর্যটকদের স্থায়ী থাকার ব্যবস্থা না হলে যে, গড়ে উঠবে না পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা। আর ঠিক সেই কারণেই ৫-তারা হোটেলের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল সিকদার গ্রুপ, আর এন্ড হোল্ডিংস। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ডিভিশনের ৬৯ নম্বর সেনা কল্যান ট্রাষ্টের থেকে অনুমতি পেতেও অসুবিধা হয়নি সংস্থাটির। 

তবে প্রাথমিকভাবে কথা ছিল ৩০ একর জমির উপরেই গড়ে উঠবে এই বিলাসবহুল হোটেল। কিন্তু শেষ অবধি তার জন্য হাজার একর অবধি কমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলেই অভিযোগ জানান স্থানীয় ‘ম্রো’-উপজাতির মানুষেরা। চিম্বুক ও নাইতাং পাহাড় জুড়ে এই প্রকল্পের জন্য বাস্তুহারা হতে চলেছে প্রায় ৭০ থেকে ১১৬টি ম্রো গ্রাম। 

মূলত জুম চাষের ওপরেই নির্ভর করে থাকেন ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। আর ঠিক সেখানেই দেখা দিয়েছে সংকট। চাষের সুযোগ হারাতে চলেছেন প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। যে ক্ষতি এক কথায় অপূরণীয়।

রবিবার ২৫টি গ্রামের ম্রো জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অংশ নেন প্রতিবাদে। প্ল্যাকার্ড, পোষ্টার, ব্যানার বানিয়েই প্রদর্শনী করা হয় ম্রো সংস্কৃতির। ছড়ানো হয় প্রচারপত্রও। সেইসঙ্গে ‘ম্রো’-দের ঐতিহ্যবাহী বিশিষ্ট বাঁশি প্লুং-এর ব্যবহারও মনে করিয়ে দেয় শতাব্দীপ্রাচীন ম্রো-দের অবস্থান। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে নির্মাণকাজ বন্ধ না হলে কঠিন অবস্থানের পথই বেছে নেবেন তাঁরা, এই বার্তাই পৌঁছে দেওয়া হয় সরকারের কাছে।

অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও নেমে আসে প্রতিবাদের ছায়া। প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ জানান ম্রো-জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। বছরের পর বছর ধরেও ওই অঞ্চলগুলিতে স্কুল কিংবা শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরিতে ব্যর্থ বাংলাদেশ সরকার। উন্নতি হয়নি অন্যান্য পরিকাঠামোরও। কিন্তু তারপর কেন পর্যটনের দোহাই দিয়ে এখন চলছে জমি অধিগ্রহণ? এই প্রশ্নই উঠে আসে প্রতিবাদে। নীলগিরি ও চাঁদের পাহাড়ের আদি নাম ‘শোং নাম হুং’ কিংবা ‘তেংপ্লং চূট’-এর কেন পরিবর্তন করে শহুরে পোশাক পরানো হল, ওঠে সেই প্রসঙ্গও।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের তথ্যচিত্র, দেখুন সেই দুষ্প্রাপ্য দলিল

উল্লেখ্য, নির্মাণ সংস্থা সিকদার গ্রুপের নাম এর আগেও জড়িয়েছে একাধিক নেতিবাচক কাজের সঙ্গে। ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ না পেয়ে ম্যানেজার এবং এমডিকে নির্যাতনের মতো ঘটনার অভিযোগও উঠেছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। চলেছিল গুলিও। তারপরও সংস্থার কর্ণধাররা প্রতিরক্ষা বিভাগকে ধুলো দিয়েই লকডাউনে দেশ ছেড়েছিল অবাধে।

তবে এই প্রতিবাদের পরেও এখনও অবধি নিশ্চুপ বাংলাদেশ সরকার। অন্যদিকে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন পাহাড়ের আদি দাবিদাররা। ১০-১২ বছর আগে বাংলাদেশের আরেক পাহাড়ি অঞ্চল সাজেকেও একইভাবে উচ্ছেদ হয়েছিল আদিবাসী খুকি সম্প্রদায়ের বহু মানুষের। নিভৃত সেই পাহাড়ি পল্লীতে গড়ে উঠেছিল বিজয় সরণী। এবার ম্রো-দের ক্ষেত্রে কি ঘটতে চলেছে সেই ঘটনাই? তেমনই আশঙ্কা নিয়ে আষাঢ়ে মেঘ দেখছেন ম্রো-রা...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
রেল লাইনের ধার থেকে বস্তি উচ্ছেদের নির্দেশ; উপযুক্ত বিকল্প তৈরি কি?

More From Author See More