রেল লাইনের ধার থেকে বস্তি উচ্ছেদের নির্দেশ; উপযুক্ত বিকল্প তৈরি কি?

শহর অথবা শহরতলির রেললাইনের সঙ্গে যেন সমার্থক তার দুই ধারের ঘিঞ্জি বস্তি। বছরের পর বছর ধরে সরকারি প্রকল্প অথবা পুনর্বাসনের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও এই বস্তির ছবি কিন্তু বদলায়নি কখনোই। দুর্ঘটনা ঘটেছে মাঝেমধ্যেই। প্রশ্ন উঠেছে কতটা সুস্থ জীবনযাপন করা যায় সেখানে, তা নিয়েও। বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাও বারংবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রেললাইনের ধারে গজিয়ে ওঠা এই বস্তি এবং তার জীবনযাত্রাকে ঘিরে। সেই প্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্ট সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে নির্দেশ দিয়েছিল রেললাইনের দুই ধার থেকে সমস্ত বস্তি উচ্ছেদ করতে। যদিও সারা দেশের জন্য এই আদেশ আসেনি। শুধুমাত্র রাজধানী দিল্লিতে এই নির্দেশ কার্যকর করার কথা বলা হয়েছিল।

রেল লাইনের ধারের এই ঘন বস্তির সঙ্গে পরিচিত কলকাতা এবং তার শহরতলির যাত্রীরাও। বস্তুত, দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় রেল চেষ্টা করছিল রেল লাইনের দুই ধার থেকে এই বস্তি সাফ করে ফেলার জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এই বস্তি উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না, তাও জানানো হয়েছিল ভারতীয় রেলের পক্ষ থেকেই। সেই প্রেক্ষাপটেই সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ, যা কার্যকর হলে রেল লাইনের ধার থেকে উচ্ছেদ হবে কম করে ৪৮ হাজার বস্তি।

রেল লাইনের ধার থেকে বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য হলফনামা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেছিল ভারতীয় রেল। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই এই মামলার রায়ে দেশের প্রধান আদালত জানিয়েছিল আগামী তিন মাসের মধ্যে খালি করে দিতে হবে সেই সমস্ত এলাকা। শুধু তাই নয়, এই কাজে বাধা দেওয়ার জন্য কোনো রকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও বরদাস্ত করা হবে না একদমই।

এই কথা সত্যি যে, রেললাইনের ধারে গড়ে ওঠা অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি বস্তিতে অসুখ-বিসুখ অথবা দূষণ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে যথেষ্টই। শুধুমাত্র রাজধানী দিল্লি নয়, বরং যে কোনও শহরের ক্ষেত্রেই এই কথা সত্যি। ২০১৮ সালে জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনালের তরফেও একটি রায়ে জানানো হয়েছিল এই দূষণ প্রতিরোধ করতে রাজধানী এলাকায় ১৪০ কিলোমিটার অঞ্চল থেকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে জবরদখল। কিন্তু তার পরেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। তাই এবার রেল উঠে পড়ে লেগেছে এই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য। কিন্তু কথা হল, যে সকল বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করা হবে তাদের ভবিষ্যৎ কী? নির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে ঝুপড়ি উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এত অসংখ্য বস্তিবাসীকে কোথায় পুনর্বাসন দেওয়া হবে সেই নিয়ে এখনও কোনো নির্দিষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন
সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘দিন্দা অ্যাকাডেমি’-র ট্রোল, ক্রিকেট কি এই স্পোর্টিং স্পিরিটই শেখাচ্ছে আমাদের?

পশ্চিমবঙ্গের দিকে যদি চোখ ফেরানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে রেলের দু’ধারের বস্তির কারণে বারংবার ব্যাহত হয়েছে রেল পরিষেবা। কখনও দুর্ঘটনা ঘটার ফলে অথবা কখনও বস্তিতে কোনো রকম সমস্যা হলে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছে রেল চলাচলে। তাছাড়াও রেলের গতি সংক্রান্ত সমস্যা তো রয়েছেই। রেললাইনের দুই ধার থেকে বস্তি উচ্ছেদের চেষ্টা তাই হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। এবং যথারীতি রাজনীতির গ্যাঁড়াকল থেকে রেহাই পায়নি সেই সমস্ত প্রচেষ্টা।

সম্প্রতি শ্রীরামপুরে রেলের জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল পরিস্থিতি। অভিযোগ উঠেছিল, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেই এই বস্তি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ রেল দপ্তর। শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো হুমকি দিয়ে জানিয়েছিলেন, কোনোমতেই বস্তি উচ্ছেদ করতে দেওয়া হবে না। উচ্ছেদ করার আগে জানাতে হবে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। তবে সেখানেই না থেমে অভিযোগ এসেছিল, ব্যারাকপুরেও রেলের জমিতে যথেচ্ছ বেআইনি নির্মাণ থাকলেও কেন হাত দেওয়া হচ্ছে না সেখানে? খোলাখুলি অভিযোগ জানিয়ে বলা হয়েছিল, সেখানে বিজেপি সাংসদ রয়েছেন বলেই কোনোভাবে রেল অশান্তি তৈরি করছে না সেই এলাকার বস্তিগুলোতে। চলতি বছরের মার্চ মাসে ঢাকুরিয়া স্টেশনের কাছে লাগোয়া বস্তিতেও আগুন লেগে গিয়েছিল ভয়াবহ। যার ফলে পূর্ব রেলের শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন চলাচল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ব্যাপকভাবে। সমস্যায় পড়েছিলেন কয়েক লক্ষ নিত্যযাত্রী। এইরকম উদাহরণ ছড়িয়ে আছে অসংখ্য। তাই প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রেলের আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে অন্য জায়গায়।

রেলের ধারে বস্তি উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা এই প্রথমবার নেওয়া হচ্ছে না। এর আগে বহুবার চেষ্টা করা হলেও কখনোই সফল হয়নি সেই উদ্যোগ। ঘুরেফিরে মূল প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন ঘিরেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, পুনর্বাসন পেলেও বস্তি ছাড়তে রাজি হননি বস্তিবাসীরা। এর একটা কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, নতুন স্থানে বস্তিবাসীদের মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে আবার অভিযোগ উঠেছে, যে আবাসন বস্তিবাসীরা পেয়েছেন তা অন্য কাউকে হস্তান্তর করে দিয়ে পুনরায় রেলের ধারে পরিচিত পরিবেশেই ফিরে এসেছেন তারা। আবার কখনও কখনও যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, পুনর্বাসন স্থল এতটাই নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি, তা কখনোই বসবাসের জন্য বিন্দুমাত্র উপযুক্ত নয়।

বর্তমানে ভারতের মোট জনসংখ্যার অন্তত ১০ শতাংশ বস্তিবাসী। এই বস্তিবাসীদের জন্যেও ভারতীয় সংবিধানে রয়েছে নির্দিষ্ট একটি আইন। ১৯৫৬ সালের ‘দ্য স্লাম এরিয়াজ (ইমপ্রুভমেন্ট এন্ড ক্লিয়ারেন্স) অ্যাক্ট’ অনুযায়ী কখনোই বস্তিবাসী মানুষদেরকে উন্নয়ন, যথাযথ পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ ছাড়া উচ্ছেদ করা যায় না। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রসংঘ পাস করেছিল হ্যাবিট্যাট থ্রি সনদ। এই সনদের অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিল ভারত। সেখানেও মোটামুটি এই একই কথা বলা আছে বস্তিবাসীদের সম্পর্কে। কিন্তু কাজের সময় এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না একটুও। তার উপর করোনা আবহের মধ্যেই কী করে বস্তিবাসীদের এত তাড়াতাড়ি পুনর্বাসন দেওয়া হবে, সে নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজো ‘বনাম’ রামলীলা : যোগী সরকারের ফরমান কি বাঙালি-বিদ্বেষেরই প্রতিফলন?

তবে এই পুনর্বাসনের প্রসঙ্গটাই কখনও সেভাবে পরিষ্কার করে উঠতে পারেনি কোনো সরকারই। পুনর্বাসনের নামে শহরের বাইরে প্রান্তিক অঞ্চলে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বস্তিবাসীদের। দূরেই সরিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে সব সময়। দরকার ছিল পুনর্বাসনের সঙ্গে সঙ্গেই বস্তিবাসীদের জন্য উন্নয়নের অন্যান্য নির্ধারকগুলির মানদণ্ডও নির্ধারণ করে দেওয়া। শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুবিধাও থাকা দরকার। নইলে হয়তো ভুলে যাওয়া হবে, এই বস্তিবাসীরাও আমাদের দেশেরই অধিবাসী; আমাদের সহনাগরিকও বটে!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More