‘সৌমিত্র নয়, আমার আসল প্রতিদ্বন্দ্বী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’, বলেছিলেন উত্তমকুমার

১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি। শ্যামবাজারের দিকে ছুটে চলেছে একটি বাস। বসে আছেন এক যুবক। দক্ষিণ কলকাতা থেকে তাঁর গন্তব্য স্টার থিয়েটারের দিকে। যুবকটির অভিনয় আছে আজ সেখানে। নাটকের নাম ‘টিপু সুলতান’। ভেতরে ভেতরে চলছে প্রস্তুতি। হঠাৎই দেখলেন, রাস্তার ধারে অগুনতি মানুষের ভিড়। মিছিল চলছে, সঙ্গে বক্তৃতাও। কীসের এত ভিড়? জানা গেল, কলকাতায় পালিত হচ্ছে ‘রশিদ আলি দিবস’। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’র আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন রশিদ আলির বিচার চলছে লালকেল্লায়। তার বিরুদ্ধেই এই প্রতিবাদ সমাবেশ। যুবকটি আর কিচ্ছু ভাবলেন না। এক নিমেষে ভুলে গেলেন স্টার থিয়েটার, ভুলে গেলেন নাটকের কথা। বাস থেকে নেমে পড়লেন ওই যুবক, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। মিশে গেলেন ওই ভিড়ে…

ওদিকে স্টার থিয়েটারে পরিস্থিতি সঙ্গীন। নির্দেশক মহেন্দ্র গুপ্ত বেশ ক্ষুণ্ণ হলেন কালী’র ওপর। তিনি যে এই নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ইতিমধ্যেই পঞ্চাশ রজনী অতিক্রান্ত হয়ে গেছে; দর্শকরাও অত্যন্ত খুশি। এমন সময় ‘স্রেফ একটা’ মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য নাটকে এল না কালী? উচিত শিক্ষা দিতে হবে। পরে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেবল ধমকই দিলেন না; ‘টিপু সুলতান’ নাটকের একশো রজনীর পুরস্কারও দিলেন না মহেন্দ্র গুপ্ত। অবাক হলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। রশিদ আলির মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিচার কি এঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়? খালি নাটক আর শিল্পচর্চাই সব? আর নামলেনই না সেই নাটকে। 

কালী বন্দ্যোপাধ্যায় এক বোহেমিয়ান নৌকার নাম। দেখতে দেখতে জন্ম শতবর্ষও প্রায় চলে এল এই কিংবদন্তি অভিনেতার। কালীবাবুর নাম শুনলে মাথায় আসে কত চরিত্র। কখনও ‘অযান্ত্রিক’-র বিমল, কখনও ‘নীল আকাশের নীচে’-র ওয়াং লু; আবার সেখানে হাজির হন ‘দাদার কীর্তি’, ‘গুরুদক্ষিণা’র সেই এক মাথা সাদা কোঁকড়ানো চুলের বৃদ্ধ। কিন্তু অভিনয় আসাটা তাঁর জীবনে নেহাতই আকস্মিক ব্যাপার। ছোটো থেকেই এক অদ্ভুত বোহেমিয়ান সত্তা নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। রাশভারী বাবাকে এড়িয়ে নানা দিকে ছুটে বেড়াতেন তিনি। সেখানে জায়গা পেত ফুটবল থেকে শুরু করে লাঠিখেলা, কুস্তিও। 

তবে সবাই ভেবেছিল, তাঁদের ‘কালী’ বড়ো হয়ে বোধহয় নামী ফুটবলার হবে। ওঁর পায়ে নাকি জাদু ছিল। ময়দানে নামলে চলত কালী বন্দ্যোপাধ্যায়েরই শাসন। এমনই ফুটবল দৌরাত্ম্য ছিল যে, বিভিন্ন ক্লাব থেকে ভাড়া করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হত। তরুণ এই ছেলেটির প্রতিভা দেখে চমকে গিয়েছিলেন স্বয়ং গোষ্ঠ পাল। কিন্তু ফুটবলার হওয়া আর হল না তাঁর। এমনকি মিলিটারিতেও ভর্তি হয়ে গেলেন এক সময়। স্বাধীনতা চেতনা, রাজনৈতিক দীক্ষা ততদিনে ভেতরে ফুটে উঠেছে। কিন্তু যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গোটা দেশ লড়ছে, তাঁদের সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে যাচ্ছি? ফিরে এলেন সেখান থেকেও। ঘুরে ফিরে জীবনের রাস্তা শেষ পর্যন্ত বেছে নিল অভিনয়কেই। সেই স্কুল জীবনে ‘কেদার রায়’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। বড়ো হয়ে সেই মঞ্চকেই বেছে নিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভাগ্যিস বেছে নিয়েছিলেন। না হলে বাংলা চলচ্চিত্র জগত কি এমন অভিনেতাকে পেত কখনও? পঞ্চাশের দশক। বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। বলা ভালো, স্বর্ণযুগের হাতছানি। আর তারই শরিক হয়ে উঠলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সূত্র ধরেই আলাপ আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই বাবার সঙ্গে কালীবাবুর আলাপ। কখনও রাসবিহারী মোড়ে, কখনও লেক মার্কেটে আড্ডা দিতেন দুজনে। প্যারাডাইস ক্যাফেতেও তখন এঁদের একটা আড্ডা ছিল। তারপর ‘বরযাত্রী’ ছবিতে দুজনে প্রথমবার অভিনয় করেন একসঙ্গে। নিউ আলিপুরে যখন থাকতেন কালী ব্যানার্জি, তখন প্রায় রোজই দেখাসাক্ষাৎ হত। এছাড়াও ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণের স্মরণে ‘বিভূতি স্মৃতি সংসদ’ বলে একটি সংগঠন ছিল। তার সঙ্গে বাবা আর কালীবাবু দুজনেই যুক্ত ছিলেন।”

এই ‘বরযাত্রী’ সিনেমার কথা অনেকের মুখেই উঠে এসেছে। ‘গণশা’ কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকদের ধাঁধিয়ে দেয়। সবার মুখে মুখে ঘোরে ওই চরিত্রটি। নিজের বইতে সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। কিন্তু তারপরও দীর্ঘ অনেক বছর বাংলা সিনেজগত তাঁকে ঠিকমতো ব্যবহারই করতে পারল না। সৌমিত্র লিখেছেন, “একটা ব্যাপার অদ্ভুত লাগে যে ‘বরযাত্রী’র এমন অনন্যসাধারণ অভিনয়ের পরেও কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনেতা হিসেবে সেরকম নামডাক হতে প্রায় দশ বছর লেগেছিল কেন?” তাঁর কাছে ‘কালীদা’ ছিলেন বাংলা সিনেমার ‘প্রথম ব্যতিক্রমী নায়ক’। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিরল অভিনেতাদের একজন, যিনি সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল তিনজনের ছবিতেই অভিনয় করেছেন। সঙ্গে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, তপন সিনহার মতো পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সত্যজিতের ‘পরশপাথর’, ‘অপরাজিত’ই বলুন; বা মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’— কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতিয়ারই ছিল তুখোড় অভিনয়। চরিত্রকে বাস্তবে নিয়ে আসার জন্য মেকআপ নিয়েও থাকতেন সচেতন।

আরও পড়ুন
প্রস্তাব ফেরালেন উত্তমকুমার, সেই চরিত্র লুফে নিয়েই বাজিমাত সৌমিত্রের

কালী বন্দ্যোপাধ্যায় যে তাঁর কাছে একজন অসাধারণ অভিনেতাই নয়, বরং তার থেকেও বেশি কিছু, সেই কথাই প্রহরকে বলছিলেন অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। “কালী বন্দ্যোপাধ্যায়দের যুগটা আজ অস্তমিত। থিয়েটার থেকে সিনেমা— সব জায়গায় ওঁরা যেরকম ধার্মিকের মতো করে অভিনয় শিল্পকে নিতেন, যেরকম পরিশ্রম করতেন সেটা সত্যিই অভূতপূর্ব। মূলত কালীঘাট অঞ্চলেই তো বেড়ে উঠেছিলেন। সেখান থেকে যখন আইপিটিএ’র মতো জায়গায় আসেন, তখন ওঁর মধ্যে নতুন অভিনয় রীতি জাগ্রত হয়। আর সেটাই প্রথমে থিয়েটার, তারপর সিনেমায় নিয়ে আসেন। ধরুন, ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটার কথা। ঋত্বিক ঘটক কালীবাবুকে ব্যবহার করছেন সেখানে। মোটরগাড়ি জগদ্দলকে পাশে নিয়ে বিমল একটি ছবি তুলবে। ধুতি-পাঞ্জাবী পরে দাঁড়িয়ে আছেন ‘বিমল’ কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই যে একটা লাজুক প্রেমিক মুখ, ওই যে একটা হাসি, যেন গাড়িটি সত্যিই তাঁর প্রেমিক— এটা রূপকথার মতো। আর ভেবে দেখুন, তারপরই বিমল বদলে যায়। এই যে অলৌকিক স্বর্গারোহণ, তারপর মর্তাবতরণ, এটা অলৌকিক একটি ব্যাপার। 

অন্যান্য ছবিগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। আমরা দেখতে পাই ‘পরশপাথর’-এ ওই ছোট্ট একটি রোলে তিনি স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর পর যে চলচ্চিত্রটি শিশুদের নজর কাড়ে তা হল ‘বাদশা’। সেখানে ডাকাতের ভূমিকায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায় সবকিছু ছাপিয়ে গেছেন। এই ছবিগুলোকে যদি আবার দেখি, তখন মনে হয় আমাদের কী সম্পদ ছিল। এবং কালী বন্দ্যোপাধ্যায়রা কেবল পাঠ বলতেন না; তাঁরা মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি অভিনয় করতে পারতেন। চোখের বিভিন্ন ভঙ্গি দিয়ে অভিনয় করে যেতেন। ‘মণিহারা’ থেকে ‘অযান্ত্রিক’— সব জায়গায় এই কথাটা খাটে। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এত বড়ো একজন অভিনেতা ছিলেন, তাঁকে কি আমরা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলাম? নাকি বাংলা ছবি অর্কেস্ট্রেশন হারিয়ে কেবল দুজনের গল্পে এসে ঠেকল?”

বাকি রইলেন ঋত্বিক। গণনাট্য সংঘে দুজনেই ছিলেন; নাটক-গান-সাহিত্য নিয়ে লড়ে গেছিলেন দুজনেই। শেষে বেরিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু ‘ভবা’র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। ‘অযান্ত্রিক’-এ কালীবাবু কেবল ‘বিমল’কেই নয়, জীবন্ত করে তুলেছিলেন জগদ্দলকেও। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘নাগরিক’-এও অভিনয় করেন তিনি। এই লিস্ট যে থামার নয়। মঞ্চ থেকে বড়োপর্দা— সব জায়গায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্ব তখন। উত্তমকুমারও তাঁকে দেখে বলে ওঠেন, সৌমিত্র নয়; তাঁর আসল ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ কালীবাবুই! কথাটার ভেতরে নিহিত শ্রদ্ধাকেও আড়াল করা যায়নি… 

আরও পড়ুন
উত্তমের নায়িকা থেকে গুরু দত্তের ‘প্যায়াসা’, অদম্য জেদেই বলিউড-জয় ‘নেপালি’ মালার

অভিনয়ই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, আবার অভিনয় করতে করতেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে চলে যাওয়া তাঁর। বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা তিনি। আজ শতবর্ষ উদযাপনের মুহূর্তে সেই জগতই কেমন যেন চুপচাপ। নিঃশব্দে সেই সারণিতে পা রাখলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। 

তথ্যসূত্র- 

১) ‘ভাঙা বাংলায় ভাঙা মানুষের রূপকার কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’, সুদেষ্ণা বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘অগ্রপথিকেরা’/ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
৩) গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র
৪) সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, ফিল্ম স্টাডিজ অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
উত্তমকুমারের ডামি হিসেবে রাজাদাকে খুঁজে পাননি চলচ্চিত্র-নির্মাতারা

Powered by Froala Editor

More From Author See More