কিম কি-দুক : অধ্যাপক-চলচ্চিত্র সমালোচক মানস ঘোষ ও সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের চোখে

মাত্র ৬০ বছরের জীবন। তার মধ্যে অধিকাংশ সময়টাই চলে গেছে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে। কখনো কাজ করেছেন ছোট্ট সিডির দোকানে, কখনো বা কারখানার হাড়-ভাঙা খাটুনি নিত্যসঙ্গী। শেষ হয়নি স্কুলের পড়াশোনাও। তারপর সেখান থেকে আর্মি, মার্চিং, বন্দুক আর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ফৌজিদারি হুকুমত। এসবের পরে যতটুকু সময় পেলেন, তার মধ্যেই নয় নয় করে তৈরি করেছেন ৩৩টি পূর্ণ-দৈর্ঘ্য সিনেমা। 

কিম কি-দুক। দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবেই পরিগণিত হন তিনি। বা আরও ভালো করে বলতে গেলে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-মহলে দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনিই। আর পাঁচজন পরিচালকের থেকে আলাদাভাবে তুলে এনেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার ছবিকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগের অধ্যাপক এবং চলচ্চিত্র-সমালোচক ডঃ মানস ঘোষের কথায়, “আশির দশকের শেষে এশিয়ান সিনেমা একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিল চলচ্চিত্রের জগতে, সেখানে ওঁর ভূমিকা অবশ্য স্বীকার্য। ওঁর ছবিতে একটা আশ্চর্য ভায়োলেন্স দেখা যায়। যেটাকে ঠিক অ্যাকশন বলা যায় না। চলচ্চিত্র যেভাবে অ্যাকশন আর ভায়োলেন্সকে এক জায়গায় নিয়ে আসে, তেমনটা নয়। এমন একটা ভায়োলেন্স যেটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং দর্শকদের ওপর একটা গভীর মনস্তাত্ত্বিক অস্বস্তি তৈরি করে। দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ ব্যবস্থায়, আপাতদৃষ্টিতে এই ভায়োলেন্সটা দেখা যায় না। দীর্ঘ সময় ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটা সামরিক শাসন চলেছে। যেখানে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত মিলিটারি, গভর্নমেন্ট এবং পুলিশ দিয়ে। মানে দমন মূলক কাজকর্ম। এবং এরা মারাত্মক ধরণের ভায়োলেন্স ইনফ্লিক্ট করেছিল গোটা সমাজের ওপরে— বিশেষ করে যুব সমাজ, ছাত্রদের ওপরে। এই ধরণের একটা চাপা বিকৃতি সমাজের মধ্যে সেটা বেরিয়ে আসে কিম কি-দুকের ছবিতে।”

একজন চলচ্চিত্রকারের দায়িত্বই থাকে আঞ্চলিক এই পরিস্থিতিকে ফুটে তোলা ছবির মাধ্যমে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কিম কি-দুকের ছবি শুধু গল্প বলে না। বরং এক রাজনৈতিকভাবে বিশৃঙ্খল সমাজের প্রতীক হিসাবেই তুলে ধরে নিজেকে। চলচ্চিত্র সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করলেন সেই কথাই, “আমরা মানে যারা আজকে আধুনিক বলে অনুকম্পিত হই কলকাতা শহরে। কিংবা আমরা যারা মোটামুটি ষাটের দশক থেকে আন্তর্জাতিক ছবি দেখছি, তাদের মধ্যে এই একটা ধারণা ছিল যে— একদিকে আছে হলিউডের বাণিজ্য ছবি, অন্যদিকে আছে ইউরোপীয় শিল্পীদের অল্টারনেটিভ ছবি। মোটামুটিভাবে যদি বলা যায় তবে ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন একদিকে— যেখানে বুনুয়েল, গদার প্রমুখের নিও রিয়ালিজম এবং অন্যদিকে হলিউডের ছবি। এই যে ধারণা ছিল, সেটা ক্রমশ সরে আসে সত্তরের দশক থেকে। যখন ল্যাটিন আমেরিকার ছবি আমরা দেখি। তারপর আমরা দেখি, ফিল্মের কেন্দ্র বলতে যা বোঝায় তার কোনো বায়োনারি ডিভিশন নেই— বাণিজ্য বনাম শিল্প। বরং অনেকক্ষেত্রেই জাতীয় সিনেমার একটা ঐতিহ্য থাকে। যেমন, ইরান, দক্ষিণ এশিয়ায় তাইওয়ান। এবং তার আগে আমাদের কথা বলা উচিত দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রের প্রায় রাষ্ট্রদূত হয়ে উঠেছিলেন কিম কি-দুক। এমন নয় যে তিনি ছবিতে দক্ষিণ কোরিয়ার যে বিশাল পুঁজিবাদী উত্থান তার মধ্যে কোনো ফাঁক ফোকর খুঁজে নিয়েছিলেন। কিন্তু যেটা খেয়াল করার ফরাসি দেশে চিত্রকলাকে পড়ার জন্য চলমান ছবিকে প্রায় চিত্রকলায় পৌঁছে দিতে পারতেন। এবং তাঁর ছবিতে গল্প বলা সেটা একটা গহন সূত্র থেকে আসে। তা বিশেষভাবে কোরিয় গল্প। অর্থাৎ কোরিয় জাতীয়তা এবং কোরিয় জাতিসত্ত্বা কীভাবে পুঁজিবাদের গ্রাসে তা একধরণের নিষ্ঠুর এবং ক্রূর জীবনচর্চায় পর্যবসিত হয়, সেটা কিম কি-দুক পরিবেশন করেন এবং তাঁর কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি শিল্প এবং বাণিজ্যকে কৌশল করে মিশিয়ে দিতে পারতেন। সেই কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন। নন্দনে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অনুষ্ঠানে একুশ শতকের শুরুতে তাঁর রেট্রোস্পেকটিভ আমরা দেখেছি। এবং যখনই দেখেছি তাতে ভিড় হয়েছে। একটা কথা থাকতেই পারে চিত্রময়তা এবং যৌনতার আতিশয্য। কিন্তু যৌনতার আতিশয্য বা চিত্রময়তা যাই থাক— তার মধ্য দিয়ে একটা অইউরোপীয় বা অ-প্রথম বিশ্বের দেশ রাজা মিজাসের রাজত্বে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন কী ধরণের অসহায় সেটা কিম কি-দুক বোঝাতে পেরেছিলেন।”

একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার, সম্মাননা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। পাশাপাশি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছেও নিঃসন্দেহে কিম কি-দুকের সিনেমা মহামূল্য সম্পদ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে সেইমাত্রার ‘জনপ্রিয়তা’ পাননি তিনি। রক্ত-মাংস, নৃশংস হত্যা, শারীরিক নিপীড়ন-ধর্ষণ— সব ধরণের বিকৃত মানসিকতাই বার বার ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর সিনেমার ফ্রেমে। বারবার অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে তাঁর সিনেমা। আর সেই কারণেই কি দর্শকদের মূল স্রোতের থেকে খানিকটা দূরেই থেকে গেলেন তিনি? অবশ্য পরবর্তীকালে সিনেমার ধরণে বদল এনেছিলেন বেশ কিছু। সেই কথা উল্লেখ করলেন মানসবাবু, “শেষ এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে কিম কি-দুক  বলা যেতে পারে আর্ট ফিল্ম সার্কিটের একজন এজেন্ট হিসাবে পরিণত হয়েছিল। শেষ কয়েক বছরে বিশেষ কিছু সিনেমা করেছেন বলে মনে হয় না আমার। নব্বইয়ের দশকে একটা গোটা সমাজকে দেখিয়ে ছিলেন আরকি— এমন একটা বিকৃতি, এমন একটা ভায়োলেন্স, যেটা রয়ে গেছে সমাজের মধ্যে। পরবর্তীকালের কিম কি-দুক ওই স্প্রিং সামার উইন্টার ফল, এই কিম কি-দুক আগের কিম কি-দুক নয়। সেটা কিন্তু ইউরোপে কীভাবে ছবি বিক্রি করব, তেমন মনোভাব নিয়ে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে একটা আর্ট ফিল্ম সার্কিটের ছবি। রিসেন্ট কিম কি-দুক যে কাজগুলো করেছেন আরকি। সেই কিম কি-দুক ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং নব্বইয়ের দশকের তাঁর কাজগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ”।

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিটি শিল্পীর ক্ষেত্রেই একটা সময় বাধ্যতামূলক ছিল সেনাবাহিনীতে কাজ করা। সেই সূত্রে কিম কি-দুক নিজেও বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছেন ব্যারাকে। আর সেই সময় কাছ থেকেই দেখেছেন এই হিংস্রতাকে। আর নিজের উপলব্ধ সেই ভায়োলেন্সকেই প্রতিটি ছবিতে মিশিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় এই হিংসা, এই যৌনতা কি ক্ষতিকর সিনেমার পক্ষে? 

“কিন্তু সিনেমার পর্দায় আমরা যেটা দেখি, সেটা তো দেখারই ছিল। সেটা তো কাউকে না কাউকে দেখাতেই হত। দক্ষিণ কোরিয়ার একটা উন্নত সমাজ, যাকে আমরা এশিয়ান টাইগার্স বলি, যেখানে গ্লোবালিজেশন হয়েছে, সেটা দেখা তো একজন শিল্পীর কাজ নয়। একজন শিল্পীর কাজ এই বাইরের মোড়কটা সরিয়ে ভেতরটা দেখানো। সেখানে সত্যিই সমাজটা তো মিসোজিনিস্ট সমাজ, মারাত্মক একটা পেট্রিয়ার্কাল, ভায়োলেন্ট, স্টেটিস্ট সব ধরণের বদগুণ যে জায়গাটায় আছে। সেইটাকে একটা ফিল্মমেকার যখন দেখাচ্ছেন তাঁকে ধন্যবাদ দিতেই হয়”, অভিমত জানালেন মানসবাবু।

আরও পড়ুন
'আমার নতুন সিনেমা ওঁকে পাঠাতে বলতেন', কিম কি-দুকের স্মৃতিচারণায় ইন্দ্রাশিস আচার্য

শুরু থেকেই একজন বিতর্কিত চরিত্র ছিলেন কিম কি-দুক। সিনেমায় এই ভায়োলেন্স ছাড়াও বারবার তাঁর নামে অভি্যোগ উঠেছে সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের। তাঁর মন্তব্য ঘিরেও জন্ম নিয়েছে হাজার বিতর্ক। ধীরে ধীরে নিজের ছবিতে দেখান চরিত্রদের মতোই কি হয়ে উঠছিলেন কিম কি-দুক? মানসবাবুর কথায়, “শেষদিকে সকলেই বলত কিম কি-দুক একজন অপারেটর হয়ে গেছেন। ওঁ আর ছবি নিয়ে ভাবেন না, ছবি করেনও না। এই বিতর্কটা হিচকককে নিয়েও ছিল কিছুটা। এক ধরণের মিসোজিনি, যে প্র্যাকটিসটা আমরা দেখতে পাই ওঁর ছবিতে। সেই মিসোজিনিটা তাঁর নিজের মধ্যেও ছিল বলে আমরা দেখেছি। ব্যক্তিগত জীবনে এই প্র্যাকটিসটা অবশ্যই ভালো কাজ নয়, কারণ তাঁর জন্য তাঁর সহকর্মীরা সাফার করছেন সেক্ষেত্রে। ডিরেক্টর হিসাবে তাঁকে পছন্দ করেন, এমন অভিনেতা-অভিনেত্রী খুবই কম পাওয়া যায়।”

প্রসঙ্গক্রমে সঞ্জয়বাবু জানালেন, “কিম কি-দুকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমাদের নানা প্রশ্ন থাকতে পারে বা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে পারে, তা নিয়ে আমি আদৌ চিন্তিত নই— সেগুলি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার। মাত্র ষাট বছর বয়স হয়েছিল, অকালেই যে তিনি মারা গেলেন— আমার মনে হয় এই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমাদের যে বিরোধ, যে আপত্তি, তার অবসান হল। কিন্তু যেটা বলার যে এশিয়া থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের এক প্রতিভূ। প্রথম প্রজন্মে ধরুন কুরোসাওয়া, সত্যজিৎ রায়, মিজোগুচি, ঋত্বিক ঘটক— এঁরা বা অন্যদিকে ইরানের আব্বাস কিরোস্তামি বা মাখমালবাফ তাঁরা। তেমন তাঁর উল্টোদিকে কিম কি-দুক একাকী হয়ে উঠেছিলেন সদ্যজাত এই নবীন পুঁজিবাদের উচ্ছ্বাস। সেই জন্যই কিন্তু  কিম কি-দুকের চলে যাওয়া চলচ্চিত্রকে যারা ভালোবাসেন তাঁদের পক্ষে বিরাট একটা ক্ষতি। চোখের আরাম তো কিছুদিনের জন্য স্তব্ধ হলই, হয়তো মনের জিজ্ঞাসাও!”

শেষ কয়েক বছর ধরেই কোনো নতুন চলচ্চিত্র আসেনি তাঁর কাছ থেকে। শুধু বেড়েছে এই অভিযোগের পাহাড়ের। কিন্তু এত কিছুর পরেও কিম কি-দুকের সিনেমা ইতিহাসের জীবন্ত দলিল হয়েই রয়ে যাবে। প্রতিফলিত করবে দক্ষিণ কোরিয়ার সামাজিক ব্যবস্থাকে। সেইসঙ্গে বিতর্কও জীবিত থাকবে কিছু হয়তো। তবে সাহসিকতার সঙ্গে, সেলুলয়েড ফ্রেমে আপোস না করে এই হিংসাকে ফুটিয়ে তুলতে নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে ঠিক কত জন এগিয়ে আসবেন, তা নিয়ে জিজ্ঞাসা চিহ্ন থেকেই যায়। সেদিক থেকে কিম কি-দুকের চলে যাওয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-জগতে একটা বড় শূন্যস্থান রেখে গেল দীর্ঘ সময়ের জন্য...

আরও পড়ুন
আবারও নক্ষত্রপতন, চলে গেলেন দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা কিম কি-দুক

Powered by Froala Editor