ঠাকুর দেখলেই যেন টুপি খুলে স্যালুট করা হয়, নির্দেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির

আগেরদিন সাহেবি পুজোর গল্প বলেছি। এবার বলি কোম্পানির পুজোর কথা। কোম্পানির শাসকরা প্রথম প্রথম দেশের নেটিভদের হাতে রাখতে ‘হিদেন’দের দুর্গাপুজোতে জোর সায় দিলেন। ভাদ্রমাস আসতে না আসতে সাহেব মেমরা অপেক্ষা করতেন কখন কোথা থেকে নিমন্ত্রণের ডাক আসবে। তাঁরা নিয়মিত কালীঘাটে গিয়ে পুজো দিতেন এমনকি নিজের বাড়িতে ঢাক ঢোল বাজিয়ে পুজোও করতেন। কোম্পানি থেকে বলেই দিয়েছিল, ঠাকুর দেখলেই যেন গোরা সাহেবরা টুপি খুলে স্যালুট করেন। তখন নতুন নতুন ব্যবসা করতে এসেছেন। এদেশের মানুষকে চটানো যাবে না কিছুতেই।

এদিকে সাহেবদের খুশি করতে বাঙালিরাও উঠে পড়ে লাগল। কালাপানি পার হলেই যে সমাজ খড়গহস্ত হত, তারাই সাহেবদের নিজের বাড়ির পুজোতে ডেকে এনে খাইয়ে দাইয়ে, বাই নাচ দেখিয়ে, ফুলের তোড়া, ফলের ঝাঁপি উপহার দিয়ে খুশি করতেন।

পুজোর মরশুম পড়তেই কাগজে কাগজে লেখা হত এবার পুজোতে কোথায় কী হচ্ছে। ১৮২৬ সালে ক্যালকাটা গেজেট লিখছে ‘এবার গোপীমোহন দেবের বাড়িতে নাচবার জন্য সুদূর ব্রহ্মদেশ থেকে একদল সুগায়িকা ও নর্তকী আনা হয়েছে।’ সাহেবরা তখন পুজো নিয়ে পাগল। নেটিভরাও সাহেবকে তুষ্ট করতে বদ্ধপরিকর। মহারাজা শিবকৃষ্ণর বাড়িতে ‘দুর্গা মাইকি জয়’-এর বদলে ধ্বনি দেওয়া হত ‘গড সেভ দ্য কুইন’। পুজো শুরুর আগে রাজা-রানির নামে জয়ধ্বনিও করা হত। শুধু তাই নয়, ইংরেজকে খুশি রাখতে পুজো শুরুর আগে সুর করে গাওয়া হত—

‘ভারত-কমলা স্বভাব চঞ্চল
ক্লাইবের বলে হইলা নিশ্চল
পুরনারী যথা স্বামীর আদেশ
সতত করয়ে পালন।’

আরও পড়ুন
পা ভেঙেছে দুর্গার বাহনের, সিংহ পরিবারের কর্তাকে ঘিরে ধরল সবাই

ফ্যানি পার্কস লিখছেন, ‘পুজোমণ্ডপের পাশেই একটি বড়ো মাপের ঘর। নানা জাতের উপাদেয়, উৎকৃষ্ট খাবার-দাবার থরে থরে সাজানো। সে সবই বাবুর ইউরোপীয় অতিথিদের জন্য। এসব খাবার দাবার সরবরাহ করে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান, মেসার্স গাটার এন্ড হপার।’ কোম্পানির মাথারা অবশ্য এই মেলামেশাকে ভালোভাবে নেয়নি। এদিকে ইয়ং বেঙ্গলরাও পুজোতে এত বাজে খরচের তীব্র বিরোধিতা শুরু করলেন। ফলে ১৮৪০ সালে বিখ্যাত ‘দশ নম্বরি আইন’ করে কোম্পানি দুর্গা পুজোর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে।

আরও পড়ুন
‘কচু ঘেঁচু’ জোটে দুর্গার কপালে! কবিতা ফাঁদলেন বঙ্কিম

ইংরেজ চিত্রকর হাচিন্সন জলরঙে এঁকেছেন কোম্পানির পুজোর শেষদিকের এক অনবদ্য চিত্র। ১৮৩২ সালে জলরঙে আঁকা এই ছবিতে সামনে চেয়ারে বসা সাহেব মেম, সামনে নৃত্যরতা বাইজী, উপরে উঁকি মেরে বাড়ির মেয়েরা— সব স্পষ্ট। 

আরও পড়ুন
ঢাকেশ্বরীর আদলে কলকাতায় অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি, এখনও চলছে সেই পুজো

মজার কথা, পর্দার আড়ালে এক ছাগলকে কাটা হচ্ছে, তাও শিল্পীর চোখ এড়ায়নি। সে বেচারার মাংস এবার সাজিয়ে দেওয়া হবে সাহেব মেমের পাতে।

Powered by Froala Editor