টালিগঞ্জে 'ব্রাত্য' ভানু, সংসার চালাতে করেছেন যাত্রাও!

ছবির শুটিং সামনে। সবাই নিজের নিজের মতো করে কাজ সামলাচ্ছেন। একসময় ঠিক হল, ‘দিল্লি চলো’। কেন? না সেখানে ছবির কিছু অংশ শুট করা হবে। ছবিতে রয়েছেন উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবীর মতো নক্ষত্রেরা। বিশেষ করে উত্তমকুমারের খ্যাতি তখন সব জায়গায়। দিল্লির হোটেলের বাইরে তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য ভিড়! এমন সময় হোটেলের রান্নাঘরে একটু গুঞ্জন শোনা গেল। সেখানেও একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে। ওঁরাও নিশ্চয়ই মহানায়কের ভক্ত? হোটেলের ম্যানেজার এগিয়ে এসে বললেন, না না। ওঁরা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখার জন্য এরকম করছেন। তিনিও আছেন কিনা এই ছবিতে; আর সবার সঙ্গে দিল্লিতেও এসেছেন! কাজেই, ‘যদি একটু রান্নাঘরে আসেন’…

বাংলা সিনেমার আঙিনায় ভানু যে ঠিক কী ছিলেন, তা নিশ্চয়ই নতুন করে বলার দরকার নেই। শুধু বাংলা নয়, তাঁর খ্যাতি বলিউডেও। মেহমুদ, বিমল রায়, কেষ্ট মুখোপাধ্যায়, শক্তি সামন্ত— গুণমুগ্ধের লিস্টি যে অনেক লম্বা! যেমন হাসিয়েছেন, তেমন কাঁদিয়েছেনও; আবার পর্দায় প্রেমও করেছেন চুটিয়ে। আর বাস্তবে? সে আরেক গল্প। ১৯৪৫ সালের ঘটনা। সঙ্গীতশিল্পী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় চলেছেন শ্রীরামপুর কোর্টের উদ্দেশ্যে। তাঁর সঙ্গেই যাচ্ছেন নীলিমা দেবী (তখনও বন্দ্যোপাধ্যায় হননি)। রাস্তাতেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে নিলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। তখন রোগাটে চেহারা তাঁর, সিনেমার জগতে ঢোকার লড়াই চলছে। ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোল’ অফিসে চাকরি করছেন। গাড়ির মধ্যে দুজনে এমন গল্প জুড়লেন যে নীলিমা দেবীর উপস্থিতি ভুলেই গেলেন। আদালতে গিয়ে তাঁদের গান পরিবেশনের পর শুরু হল ভানু’র খেল। তাঁর হাসানোর ঠেলায় সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। হঠাৎই সিদ্ধেশ্বরবাবু নীলিমা দেবীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওকে বিয়ে করবি?’ তারপরেই কথাবার্তা শুরু এবং স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে পরিণয়ে আবদ্ধ হন দুজনে। 

একটা সময় সমস্ত মানুষ, শিল্পীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আদায় করেছেন তিনি। আজও সেই ধারা অব্যাহত। বাংলা সিনেমার ইতিহাস ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে অসংখ্য ঝড় দেখেছেন তিনি। বিয়ে করেছেন, একটা চাকরিও করছেন বটে; কিন্তু স্বপ্ন তো অভিনয় করার। দ্বিরাগমনের দিন জীবনে প্রথমবার শুটিংয়ে গেছেন তিনি, ‘জাগরণী’ ছবিতে এক দুর্ভিক্ষ পীড়িতের চরিত্রে সামান্য সময়ের অভিনয়। সেটাই বা কে দেয়? নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি; সব জায়গা থেকে ফিরে আসছেন। প্রযোজকদের বক্তব্য, জিভের ‘আড়’ নাকি এখনও ভাঙেনি তাঁর। পরবর্তী সময় সেই প্রযোজকরাই যখন কাজ দেওয়ার জন্য ডেকেছেন; তখন ভানুর মুখে পারিশ্রমিকের অঙ্ক শুনে চক্ষু চড়কগাছ! এত টাকা কেন? ভানুর সটান উত্তর, ‘ওই জিভের আড় ভাঙার মূল্য দেবেন না?’

ভানু আর তাঁর ঢাকাই বাঙাল ভাষায় কথা বলা, এ আজ কিংবদন্তি। ‘মাসিমা মালপো খামু’ কে ভুলেছি! অজান্তে নিজেরাও কখনও বলে ফেলেছি এইভাবে। সাহসের কোনো কমতি ছিল না জীবনে। হবে নাই বা কেন! একটা সময় দেশকে স্বাধীন করার জন্য বিপ্লবী আন্দোলনেও ঢুকে পড়েছিলেন। রাসবিহারী মোড়ে আড্ডার জায়গায় একদিন এসে হাজির হল এলাকার ত্রাস ‘নেলো’, সঙ্গে বেশ কয়েকজন সাকরেদ। এসেই ভানু’কে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছোকরা তোর নাম কী?’ অপর পক্ষও কম যান না। মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘তুই কে?’ অমন এক গুন্ডার সামনে এরকম ভাবে কথা বলার কথা কেউ ভাবতেই পারেনি। নেলোও বুঝতে পারেনি প্রথমে; তারপর বুক বাজিয়ে হুংকার, ‘আমি কালীঘাটের নেলো’। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আমি ঢাকার ভুলো’! শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে হাতে উঠে এল দোকানের কয়লা ভাঙার হাতুড়িটাও। ওইদিনের বাকি গল্পটা জানা না গেলেও, এই নেলোই পরবর্তীতে ভানু-ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। 

প্রায় একই ঘটনা ঘটে রাম চ্যাটার্জির সঙ্গেও। চন্দননগরের ‘নামকরা’ লোক তিনি, তাঁর নামে নাকি সবাই বাপ বাপ বলে পালায়। তাঁর সাকরেদরা ভানু-কে এসে রীতিমতো জানান দিয়ে গেল, অমুক দিন রামদার ফাংশান, তমুক সময় পৌঁছে যাবেন। এমন ঔদ্ধত্য দেখে অবাক ভানু! সঙ্গে সঙ্গে নিজের রণমূর্তি ধারণ করলেন তিনি। ‘নিয়া যাইতে পারে তবে আমার লাশ নিতে লাগব।’ তবে এক্ষেত্রে নেলোর মতো ভুল করেননি রাম চ্যাটার্জি। ‘ভানু’ যে কী জিনিস, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। দিন কয়েক পরে নিজেই হাজির একদিন। রীতিমতো ক্ষমা চাইলেন তিনি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একটিবার না গেলে তো মানসম্মান থাকবে না! শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন তিনি। 

অন্যায়ের সঙ্গে কোনোদিনও আপোস করেননি ভানু। যেখানেই দেখেছেন, প্রতিবাদ করে উঠেছেন সঙ্গে সঙ্গে। ষাটের দশকের শেষের দিকে বাংলার সিনেমার জগতে শুরু হল আন্দোলন। প্রযোজকদের বিরুদ্ধে টেকনিশিয়ানদের এই আন্দোলনে তাঁদের পাশে দাঁড়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়রা। তখন এঁরা সবাই মিলে তৈরি করেছেন ‘অভিনেতৃ সংঘ’। সবই চলছিল ঠিকঠাক, হঠাৎ দেখা দিল ফাটল। অভিনেতৃ সংঘ ভেঙে গেল। উত্তমকুমারের মতো কয়েকজন বেরিয়েও গেলেন। প্রযোজকদের বিরুদ্ধে যারাই রুখে দাঁড়াচ্ছিলেন, তাঁদেরই ছবিতে নিতে অস্বীকার করতে লাগলেন সবাই। এই সময়ই প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রযোজকদের সঙ্গে এই আপোস তিনি মানতে পারেননি। কাজেই, পাঁচ-পাঁচটা বছর টালিগঞ্জের কাছে তিনি ‘ব্যানড’ রয়ে গেলেন। এদিকে চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছেন আগেই। কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে! 

আরও পড়ুন
উত্তমের চোখে তখন আদর্শ নায়ক অসিতবরণ, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ইচ্ছে বিমল রায়ের মতো পরিচালক হবেন

এবার ভানু বেছে নিলেন যাত্রাকে। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অভিনয় করতে লাগলেন। কিন্তু নিজে যেচে কারোর কাছে কাজ চাইতে যাননি। তাঁর কাছে যেটা অন্যায়, সেটা অন্যায়। তার সঙ্গে কোনোমতেই আপোস নয়। ১৯৭৪ সালে তৈরি করলেন ‘মুক্তমঞ্চ’ নামের এক যাত্রাদল। অসুস্থ, কিন্তু তাও মাঠে ঘাটে ঘুরে কাজ করে যাচ্ছেন। সংসারটা যে বাঁচাতে হবে! যে মানুষটা নরম বিছানা না হলে ঘুমোতেন না, তিনিই অবলীলায় মাটিতে ঘুমোচ্ছেন। শুধু জিলিপি খেয়ে কেটেছে দিনের পর দিন। হঠাৎ একদিন ঘটে গেল এক কাণ্ড। ঘুমের মধ্যে ভানুর বুকের ওপর খসে পড়ল সিলিং ফ্যান। সব সহ্য করেছিলেন তিনি, নীরবে।

একের পর এক ছবিতে কাজ করে গেছেন। তাঁকে নেওয়ার জন্য পথ চেয়ে থাকত পরিচালকরা। আবার অনেক সময় এমনও হয়েছে, সেই পরিচালকরাই ছবি করিয়ে টাকা দেননি। হয়ত তিন-চার বছর পর বকেয়া টাকা দিতে এসেছেন; ভানুর বাড়ি কাঁপানো চিৎকার! তবে, সবাই যে বলে মানুষের সততা নাকি ফুরিয়ে গেছে! এই তো বকেয়া টাকা দিতে এসেছে। কিছু সময় সেই সুযোগও হয়নি। কিন্তু নিজের নীতিগত জায়গাটা কখনও হারাননি তিনি। 

মাস্টারদার সহযোগী এবং বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভক্ত ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বিপ্লবীদের দেখতেন শ্রদ্ধার চোখে। এই অনন্ত সিংহই ভানুর ছবি প্রযোজনাও করেছিলেন। প্রথম দুটি ছিল ‘শেষ পরিচয়’ আর ‘নতুন প্রভাত’। সেরকম জায়গা করতে পারেনি ছবি দুটি। এর পরেরটাই ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। এই সিনেমাটির আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার নিশ্চয়ই দরকার নেই। তবে আশ্চর্যের বিষয়, অনন্ত সিংহের প্রযোজনায় যত ছবি করেছেন, একটির থেকেও টাকা চাননি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অমন মহান এক বিপ্লবীর কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায়! উল্টে অনেক সময় টাকা দিয়েছেন। এমনই ছিলেন ভানু। ‘কৌতুকাভিনেতা’ শব্দ থেকে কৌতুক সরিয়ে দিন। একজন জাত অভিনেতাই ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও লড়াই করে গেছেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু হাসাতে ভোলেননি। আমরাও হাসতে ভুলিনি তাঁর জন্য...

আরও পড়ুন
শুধু উত্তমকুমারই নন, অন্যান্য নায়কদের কণ্ঠেও অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

তথ্যঋণ— ‘লেখালেখি’/ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More