যুদ্ধক্ষেত্রেও হারায়নি মানবিকতা, আমেরিকার বোমারু বিমানকে ‘জীবনদান’ জার্মান পাইলটের

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়ে এসেছে। ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে জার্মানি। আর জার্মানির কফিনে শেষ পেরেকটি গেঁথে দিতে মরিয়া আমেরিকাও। এমন সময় পরিকল্পনা নেওয়া হল জার্মানির বার্মেন শহর আক্রমণের। আমেরিকার বিমান বাহিনীও প্রস্তুত। বিশ্বের সবচেয়ে কুশলী বিমান বাহিনীতে তখন একঝাঁক তরুণ মুখ। তার মধ্যেই একজন চার্লি ব্রাউন। তেমন বড় কোনো সংঘর্ষের নেতৃত্ব পাননি তখনও। সেই প্রথম। ১৯৪৩ সালের ২০ ডিসেম্বর। বার্মেন শহরের আকাশ ঘিরে ফেললেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট চার্লি ব্রাউন এবং তাঁর প্রথম নিজস্ব বাহিনী।

আমেরিকার বিমান বাহিনীর কাছে আছে অত্যাধুনিক বি-১৭ বিমান। অন্যদিকে পিছিয়ে নেই জার্মান বাহিনীও। বার্মেন শহরের সুরক্ষার জন্য সবদিক থেকেই প্রস্তুত জার্মানি। আমেরিকার একের পর এক বিমান ধরাশায়ী হতে বেশি সময় লাগল না। এর মধ্যেই ভুল করে শহরের বাঁ দিকে ঘুরে গেল চার্লির বিমান। আর সেখানেই সমস্ত মহড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে জার্মানির বিমান বাহিনীও। চার্লির বিমানকে ঘিরে ফেলল প্রতিপক্ষের আটটি বিমান। অন্যান্য বিমানগুলো তখন শহরের উপর বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। জার্মানির অভিজ্ঞ সেনানায়করা বুঝেছিলেন, নেতৃত্বকে ধরাশায়ী করতে পারলেই তারা এই যুদ্ধ জিতে যাবে। তাই একের পর এক আক্রমণ হতে থাকল চার্লির বিমানের উপর।

টেল গানার সার্জেন্ট ইকি মারা গিয়েছেন ইতিমধ্যে। গুরুতরভাবে আহত আরও ৯ জন সৈন্য। বিমানের অধিকাংশ যন্ত্রপাতিও ভেঙে পড়েছে। আর লেফটেন্যান্ট চার্লি? ঘাড়ের কাছে দগদগ করছে রক্ত। কোনরকমে মরফিনের প্রভাবে কোনরকমে যন্ত্রণা সামলে আছেন তিনি। কিন্তু বেশিক্ষণ আর পারলেন না। আচমকাই জ্ঞান হারালেন তিনি। আর জ্ঞান ফিরেই প্রথম নির্দেশ দিলেন, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বিমান নিয়ে যেতে।

শরীরে একাধিক গুলির ক্ষত আর অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করছিল না চার্লির। কিন্তু এটুকু বুঝেছিলেন, এভাবে বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব নয়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর বিমান ভেঙে পড়বে। তাই ভাঙাচোরা বিমান নিয়েও দ্রুত উপরে উঠতে শুরু করলেন চার্লি। তাঁদের পালাতে দেখেই পিছনে ছুটে এলেন জার্মানির পাইলট ফ্রাঞ্জ স্টিগলার। শুধু বিমানে জ্বালানি ভরতে যতক্ষণ লাগে, চার্লির কাছে পৌঁছতে তার বেশি সময় লাগল না স্টিগলারের। আর জার্মানির সেনাবাহিনীতে তাঁর মর্যাদাও তো কিছু কম নয়। প্রায় ৪০০ সংঘর্ষের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পেয়েছেন নাইটস' ক্রসও। তাঁর নিখুঁত লক্ষ্যভেদে বিধ্বস্ত হতে লাগল বি-১৭।

আরও পড়ুন
নাইট উপাধি পেতে চলেছেন ক্যাপ্টেন টম মুর, ১০০ বছরেও অক্লান্ত বিশ্বযুদ্ধের এই সৈনিক

এই প্রাণঘাতী যুদ্ধের ময়দানে হঠাৎ দুই মহাবীরের চোখে চোখ পড়ল। যদিও একে অন্যের প্রতিপক্ষ, কিন্তু দেশে দেশে বীরদের বোধহয় একটাই জাতিসূত্র থাকে। তাই কীভাবে যেন সমস্ত রাজনৈতিক সমীকরণ উল্টে গেল। দূর থেকে যেন শোনা গেল জিঙ্গল বেলের ধ্বনি। আর তো ক'টা দিন। তারপর ক্রিসমাস আসছে। কিন্তু কোনরকম করুণা চাননি চার্লি। শুধু নির্বাক চোখ বুজলেন। আর তারপরেই...

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বেতার বার্তা, প্রকাশ পেল ৭৫ বছর পর

স্টিগলার জানতেন না কোথায় চলেছে বি-১৭। হয়তো জানতেন না চার্লিও। শুধু জানতেন ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে যেতে পারলেই নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাবেন। আর স্টিগলার যেন দেখতে পেয়েছিলেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষগুলো বড়দিনের সন্ধ্যায় মেতে উঠেছে পরিবারের সঙ্গে। অবশ্য চার্লি তাঁকে ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের ডেরায় নিয়ে গিয়েও ফেলতে পারতেন। কিন্তু তেমন কিছুই করেননি। বিধ্বস্ত বিমানটিকে ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত পার করে দিয়ে ফিরে এসেছিলেন স্টিগলার।

আরও পড়ুন
নাৎসিদের ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষে, ৯৭ বছরে প্রয়াত বিশ্বযুদ্ধের সেনানী

আর চার্লি? সুস্থ হয়েই খুঁজে বের করেছিলেন স্টিগলারকে। কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে তো। দীর্ঘ ফোনকলে সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই শুরু হল নতুন বন্ধুত্ব। আর সেই বন্ধুত্ব থেকে গিয়েছিল জীবনের শেষ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন
আয়না ও সূর্যের আলো দিয়ে শত্রুনাশ, বিশ্বযুদ্ধে এমনই পরিকল্পনা ছিল নাৎসিদের

এই পৃথিবীর উপরে নানা দেশের মানচিত্র থাকবে। দেশে দেশে লড়াই থাকবে। রাজনীতির উত্থান-পতন থাকবে। তার মধ্যে এই মানবিক গল্পগুলোও কি থেকে যাবে না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো শুধু চার্চিল-স্ট্রুম্যান আর হিটলার-মুসোলিনির গল্প নয়, চার্লি আর স্টিগলারেরও গল্প। আর সমস্ত সময়েই মানুষের বেঁচে থাকার ইতিহাসে এইসব মানবিক গল্পগুলোই তো ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More