ছিলেন চোরাশিকারি, পরবর্তীকালে নিজের জীবন বিপন্ন করে রক্ষা করেন কঙ্গোর জঙ্গল

ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটছেন এক ব্যক্তি। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ তো রয়েছেই; নিজের প্রাণের ভয়, সঙ্গে এই জঙ্গলকে রক্ষার দায়। চারিদিকে ঘোরাফেরা করছে তাঁর সাথীরা। কেবল মানুষই মরছে না তাঁদের হাতে। শেষ হচ্ছে জঙ্গলের নিরীহ প্রাণীরা। এরকম করলে যে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা হতে দিতে পারেন না কর্নেইল ইওয়াঙ্গো। নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করে এই জঙ্গলকে বাঁচাতে হবে… 

আফ্রিকার কঙ্গোর ইটুরি রেনফরেস্ট। বাংলায় যাকে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলা হয়। সেই ছোটো থেকেই এই ঘন বন-সংলগ্ন অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন কর্নেইল ইওয়াঙ্গো। কিন্তু সেসব খুব সুস্থ পরিবেশ ছিল না। কঙ্গোর যে গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন, সেখানে প্রায় প্রতিটি ঘরেই চোরাশিকারির বাস। বলা ভালো, চোরাশিকারই ছিল এখানকার প্রধান জীবিকা। দেখতে দেখতে কর্নেইলও সেই চক্রে জড়িয়ে পড়েন। ছেলেবেলায় বাবা-কাকার সঙ্গে যেতেন জঙ্গলে। হাতি, পাখি-সহ যে প্রাণীদের সামনে পেতেন, হত্যা করতেন। কখনও মাংসের জন্য, কখনও আবার মহামূল্য হাতির দাঁতের জন্য। কর্নেইলের কাছে এই পুরো ব্যাপারটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনই তো দেখে এসেছেন জন্ম থেকে।

এমনটাই হয়তো ভবিষ্যতের জন্য লেখা হয়ে যেত। কিন্তু হলনা; বলা ভালো এরপর থেকেই এক লড়াইয়ের জন্ম হল। চোরাশিকারের ফলে একটু একটু করে প্রাণীদের সংখ্যা কমছিল। জঙ্গলও ধ্বংস হচ্ছিল একইসঙ্গে। এমন সময় শিক্ষার ছোঁয়া পেলেন কর্নেইল ইওয়াঙ্গো। ভর্তি হলেন স্কুলে। আফ্রিকার গহীন অঞ্চলেও একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে শিক্ষার আলো। চোরাশিকারের দুঃস্বপ্ন তখন অতীত। কর্নেইলের চোখে তখন ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা। যত পড়াশোনা বাড়তে লাগল, ততই নতুন নতুন জিনিসের সামনে এসে পড়লেন তিনি। এমন সময় হাতে তুলে নিলেন জীববিদ্যার বই। পৃথিবীর এক বিস্ময় তাঁর সামনে খুলে গেল। কিসাঙ্গানি বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যা নিয়েই ভর্তি হলেন তিনি। 

পরিবেশ সংরক্ষণ কেন গুরুত্বপূর্ণ, কেন চোরাশিকার অবৈধ, এই সমস্ত বিষয় একটু একটু করে তাঁর কাছে স্পষ্ট হতে লাগল। চোখের সামনে কালো পর্দাটা খুলে গেল। ১৯৯৫ সাল। কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে বেরোলেন কর্নেইল ইওয়াঙ্গো। তাকালেন নিজের দেশ, কঙ্গোর দিকে। আফ্রিকার বনজ সম্পদে ভর্তি এই দেশ। আর সেইসঙ্গে রয়েছে ইটুরি জঙ্গল। আজ থেকে তো নয়, হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হয়েছে এই জায়গাটি। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই জঙ্গল। আর তাকেই কিনা এতদিন ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন!

আরও পড়ুন
মানুষ নয়, অ্যাডির্নোডাক জঙ্গলকে সংকটে ফেলেছে ছোট্ট বীবর

শেষ পর্যন্ত সেই ইটুরি ফরেস্ট রিজার্ভেই কিউরেটরের চাকরি নিয়ে চলে এলেন কর্নেইল। শুধু গাছপালাই নয়, ইটুরি জঙ্গলের প্রধান আকর্ষণ ওকাপিকেও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেন। খয়েরি রঙের শরীর, মুখের অংশ সাদা আর চারটে পা-এ জেব্রার মতো সাদা-কালো ডোরাকাটা। ওকাপি’র এমন রূপই দেখে এসেছে বিশ্ব। কিন্তু এমন একটা সময় কর্নেইল চাকরিতে এসেছিলেন, যখন আফ্রিকায় আগুন জ্বলছে। জাইরে, কঙ্গো-সহ বেশ কিছু জায়গায় শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ। হাজার হাজার মানুষ নিজের জায়গা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও আরও বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সেখানে। বিদ্রোহীরা সরকারের সমস্ত লোককে নিশানা বানিয়েছে। কর্নেইল ইওয়াঙ্গো তখন ইটুরির ওকাপি ফওনাল রিজার্ভের চিফ বোটানিস্ট। কাজেই, বন-জঙ্গল, সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করলেও, তিনিও সরকারেরই লোক। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে এবং তাঁর সহকর্মীদেরও নিশানা করা হল। প্রতিটা দিন প্রাণের ভয় নিয়ে কাজ করতে হত সবাইকে। এমন প্রাণের সংশয় নিয়ে কি মন দিয়ে কাজ করা যায়? একটা সময় পর কর্নেইলের সহকর্মীরা কাজ ছেড়ে চলে গেলেন সুরক্ষিত জায়গায়। 

কর্নেইলের কাছেও সুযোগ ছিল পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তিনি গেলেন না। তাহলে এই প্রাণীগুলোর কী হবে? ইটুরির কী হবে? মানুষের পাশাপাশি এই জঙ্গলও যে শেষ করে দেবে বাকিরা। এমনই তখন অবস্থা। দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলেন কর্নেইল। দরকারে জীবন যাবে; কিন্তু এই বন ছেড়ে তিনি যাবেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে গেলেন তিনি। সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাসস্থান ছাড়লেন কর্নেইল ইওয়াঙ্গো। চলে গেলেন জঙ্গলের ভেতর। দীর্ঘ তিন মাস ওখানে আত্মগোপন করেছিলেন তিনি। ছোটো থেকেই এমন পরিবেশে বড়ো হয়েছেন, তাই অসুবিধা হবে না তাঁর। সবথেকে বড়ো কথা, জঙ্গল ছেড়ে যেতে হবে না তাঁকে। বাইরে বেরোলেই যে গুলি চলবে তাঁর শরীর লক্ষ্য করে… 

আরও পড়ুন
কলম্বিয়ার জঙ্গল বাঁচাতে বিজ্ঞানীদের সহায় প্রাক্তন গেরিলারাই

সংখ্যায় তিন মাস; কিন্তু বাস্তবে যেন অনন্ত অপেক্ষা। গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে জঙ্গল মুছে দিতে চাইছে উন্মত্ত মানুষরা। গাছপালা কেটে, মাটির নিচ থেকে সোনা, হিরে, রুপো সংগ্রহ করতে চাইছে তাঁরা, মেরে ফেলতে চাইছে সমস্ত প্রাণীদের। এই সমস্ত কাজ ছাড়াও আরও একটি কাজ করতেন কর্নেইল। জঙ্গলের আশেপাশে যখন চোরাশিকারিদের উপস্থিতি বুঝতে পারেন, তখন সেই খবর গোপনে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি। একটা সময় চোরাশিকারিদের মধ্যে থেকেছেন বলেই সমস্ত কায়দাকানুন জানতেন। ইটুরির জঙ্গল এবং সেখানকার প্রাণীদের জন্য সবরকম বিপদের সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন কর্নেইল। এরা না বাঁচলে তো আমরাও বাঁচব না! 

শেষ পর্যন্ত জয় হল তাঁর চেষ্টার। অনেক চোরাশিকারি যেমন ধরা পড়ল, তেমনই গৃহযুদ্ধও থেমে গেল। সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হলেন কর্নেইল। আর এই গোটা সময়টা প্রায় একাই জঙ্গল আঁকড়ে পড়ে থাকলেন। দিনের শেষে তাঁর সহকর্মীরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ওকাপি রিজার্ভে এতটুকুও আঁচড় পড়েনি। কোনকিছু নষ্ট হয়নি; জঙ্গল ঠিক যেন আগের মতোই সবুজ। চমকে গেল গোটা আফ্রিকা। আর এই পুরো কাজের পিছনের মানুষটি যে কর্নেইল ইওয়াঙ্গো, সে সম্পর্কেও নিশ্চিন্ত হলেন তাঁরা। একের পর এক সম্মান পেলেন তিনি। আজ তিনি ওকাপি রিজার্ভের ডিরেক্টর। জীব সংরক্ষণ নিয়ে একের পর এক কাজ এখনও করে চলেছেন তিনি। এতকিছুর পরেও একই রকম সাধারণ, সহজ কর্নেইল ইওয়াঙ্গো। তাঁর লক্ষ্য, আফ্রিকার যুবকরাও যাতে এই কাজে এগিয়ে আসেন। তাহলেই একটা সুন্দর, সতেজ পৃথিবীর লক্ষ্যে এগিয়ে যাব আমরা। আরও কর্নেইলের জন্ম দেবে প্রকৃতি। 

আরও পড়ুন
৬০০০ বছর পরে ইংল্যান্ডের জঙ্গলে ফিরছে বাইসন

তথ্যসূত্র-
1) ‘Risking my life to protect Congo’s rainforest’, BBC News
2) ‘Corneille Ewango’, Future for Nature     

Powered by Froala Editor

More From Author See More