স্পঞ্জ আয়রন কারখানা কর্তৃক অবৈধ জমি অধিগ্রহণ, প্রশাসনকে জানিয়েও অধরা সুরাহা

দোড়গোড়ায় নির্বাচন। আর তাই গোটা রাজ্যজুড়েই চলছে ভোটের প্রচার। লম্বা ইস্তেহার প্রকাশ করছে রাজনৈতিক দলগুলি। বার বার উঠে আসছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য সত্যিই কি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বাস্তবে? ঝাড়গ্রামে ফুটে উঠছে সেই ছবিই। প্রশাসনের কাছে বেআইনিভাবে জমিদখলের অভিযোগ করেও কোনোরকম সুরাহা পাচ্ছেন না জিতুশোলের গ্রামবাসীরা। অসহায়তার, অনিশ্চয়তার মধ্যেই দিন কাটছে তাঁদের।

ঝাড়গ্রাম জেলার জিতুশোলে রয়েছে রেশমি সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড-এর স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। ক্রমাগত বলপূর্বক রায়তি ও পাট্টা জমির দখল চালিয়ে যাচ্ছে তারা। গত শুক্রবার মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরে এই অভিযোগ জানিয়েই চিঠি লিখলেন বাঘমুড়ি গ্রামের বেশ কিছু বাসিন্দা। অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে জেসিবি দিয়ে জমির আল কেটে অবৈধভাবে চলছে জমির দখল। কাউকে না জানিয়েই কারখানার পরিধি বাড়িয়ে প্রাচীর নির্মাণ করেছে সংস্থাটি।

তবে শুধুই কি জমিদখল? বহু আগে থেকেই কারখানার বর্জ্য পদার্থ ফেলা হয় গ্রামবাসীদের আবাদি জমিতে। “তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে হেনস্থা হয়ে হয় গ্রামবাসীদের। ৫০-৬০ জন সিকিওরিটি ভাড়া করে মারধরও করা হয়েছে অনেককে”, জানালেন বাঘমুড়ির এক জনৈক বাসিন্দা। 

তবে এতকিছুর পর সচেতন হননি কারখানার কর্তৃপক্ষ। উল্টে জমির মালিক-সহ অন্যান্য গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন তাঁরা। রুজু করা হয়েছে ‘অ্যাটেমপ্ট টু মার্ডার’-এর মামলা। হেনস্থার শিকার হয়ে তাঁরাই এখন কারাবন্দি। জামিনটুকুও মেলেনি অনেকের। এই বিষয়ে একাধিকবার জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোনো সদুত্তর মেলেনি গ্রামবাসীদের।

আরও পড়ুন
জমি অধিগ্রহণ, প্রকৃতি-নিধন করে নির্মাণকাজ; প্রতিবাদে লং মার্চ ম্রো জনগোষ্ঠীর

তবে এখানেই কি শেষ? এই কারখানার জন্যই উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন গ্রামের মানুষদের একটা বড়ো অংশ। দায়ী, মাত্রাহীন দূষণ। মূলত কৃষিকাজের ওপরেই নির্ভরশীল এই গ্রামের অধিবাসীরা। আর বন্ধ হতে বসেছে সেই কৃষিকাজই। “সারা গ্রামে কারখানা থেকে লোহার গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ে। জমিতে মোটা আস্তরণ বিষাক্ত ধুলোর। তার মধ্যে চাষ করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে”, জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও এক গ্রামবাসী।

আরও পড়ুন
পাঁচতারা হোটেলের জন্য জমিদখল, প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী ‘ম্রো’-রা

কথায় জানা গেল গত ১৫ বছরে এই দূষণের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের কঠিন অসুখ। গোটা অঞ্চলজুড়ে পাখিদের আনাগোনাও বন্ধ হয়ে গেছে দূষণের জেরে। তাছাড়াও ১২ কিমি দূরে জেলা শহর অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পাঁচ নম্বর রাজ্য সড়ক ধরে বাইকে যাতায়াতের সময় কারখানার গেটের কাছে প্রায় কিছুই দেখা যায় না। স্পঞ্জ আয়রনের ধুলো ঘূর্ণিঝড়ের আকার নেয়! দুর্ঘটনাপ্রবণ করে তোলে মানুষের যাতায়াত। এছাড়াও সরকারি জমির উপর শাল সহ অন্যান্য মূল্যবান বৃক্ষের জঙ্গল সাফাই করেও অবাধে নির্মাণ চলছে কোম্পানির প্রাচীরের। 

আরও পড়ুন
চাষের জমি থেকে উদ্ধার প্রাচীন সূর্যমূর্তি, চাঞ্চল্য অন্ধ্রপ্রদেশে

কয়েকমাস আগে বাঘমুড়ি ও শালবনি গ্রাম সংসদের মানুষরা শালবনি পঞ্চায়েত অফিসে বেআইনি ভাবে কারখানা কর্তৃপক্ষকে নতুন ইউনিটের ট্রেড লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ও লাইসেন্স বাতিলের দাবিতে ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছিলেন। ভূমি দপ্তরে করা আরটিআই রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায় বাঘমুড়ি মৌজায় (জেএল নং-৯২৮) এবং খাসজঙ্গল মৌজায় (জেএল নং ৭৩১) ওই কারখানার কোনো জমিই নেই। তা সত্বেও কীভাবে কোম্পানি দখল নেয় এবং প্রশাসন নীরব থাকে উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না গ্রামবাসীরা।

তবে সবথেকে বড়ো প্রশ্ন গোটা অঞ্চলটিতে মূলত বসবাস তফসিলি গোষ্ঠীর মানুষদের। সংবিধান অনুযায়ী তাঁদের বসবাসযোগ্য জমি অধিগ্রহণ তো দূরের কথা, কেনাও আইনত অপরাধ। তা সত্ত্বেও কেন চুপ প্রশাসন, উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ-ই। এই লাল সুতোর ফাঁস ঠিক কবে কাটবে তাও জানা নেই তাঁদের। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা তো বটেই, কোনো সংবাদমাধ্যমও সাহায্যে এগিয়ে আসনি, এমনটাই উঠে আসছে এলাকাবাসীদের ক্ষোভে…

Powered by Froala Editor