প্রয়াত গদারের 'নিউ ওয়েভ'-এর পোস্টার বয় জঁ-পল বেলমন্দো

“আফটার অল আই অ্যাম স্টুপিড। আফটার অল, ইয়েস, আই মাস্ট।” এভাবেই শুরু হয়েছিল পথভোলা এক চরিত্রের যাত্রাপথ। যার পকেট গড়ের মাঠ। খিদেয় পেট জ্বললে হঠাৎ বান্ধবীর ফ্ল্যাটে গিয়ে দু-এক পয়সা চুরি করে আনে সেখান থেকে। কখনও আবার শহরের কোনো গাড়ি চুরি করে অন্যত্র পালানো। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে ব্রেথলেস সিনেমার মূল চরিত্র মিশেলকে নিয়ে। চলচ্চিত্রের জগতে এহেন চরিত্র তার আগে হয়তো আসেনি কখনো। আসেনি এমন চরিত্র ফুটিয়ে তোলার মতো অভিনেতাও। কারণ, গদারের এই চরিত্র তো অনেকটাই আসলে নির্মিত অভিনেতার পার্সোনার ওপরে ভিত্তি করেই।

হ্যাঁ, তিনি জঁ পল বেলমন্দো। ষাটের দশকে পরিচালক গদারের হাত ধরে চলচ্চিত্রের যে নিউ ওয়েভের সূচনা হয়েছিল, সেই অধ্যায়ের অন্যতম পোস্টার-বয় তিনি। ‘ব্রেথলেস’-এর আগে পরে একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও, তিনি পরিচিত হয়ে রয়ে গেছেন মিশেল হিসাবেই। সেই ঐতিহাসিক অধ্যায়েই ইতি পড়ল এবার। গতকাল ৮৮ বছর বয়সে বিদায় জানালেন জঁ পল বেলমন্দো। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুখে ভোগার পর প্যারিসে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন পর্দার মিশেল।

১৯৩৩ সাল। ফ্রান্সের নিউলি-সুর-সিনে শহরতলিতে জন্ম বেলমন্দোর। বাবা ছিলেন ফরাসি উপনিবেশ আলজিরিয়ার বাসিন্দা। পেশায় একজন ভাস্কর। কাজের সূত্রেই ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে চলে আসা তাঁর। জঁ-পলের বেড়ে ওঠা খানিকটা পরিচর্যার অভাবেই। কাজের সূত্রে বাবাকে অধিকাংশ সময়ই থাকতে হত বাইরে। বোহেমিয়ান জীবনের পথে হাঁটা শুরু সেই থেকেই। পড়াশোনার থেকে খেলাধুলোই ছিল তাঁর প্রথম পছন্দ। 

আদৌ হয়তো অভিনেতা হওয়ার কথা ছিল না বেলমন্দোর। বরং, চাইলে সফল বক্সার হতে পারতেন তিনি। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই বেলমন্দোর হাতেখড়ি হয় বক্সিং-এ। প্রথমে অপেশাদার বক্সিং খেললেও ১৯৪৯ সালে অ্যামেচার বক্সিং-এ প্রথম রিং-এ নামেন তিনি। আর সেখানেই যেন ম্যাজিক খেলে যায়। প্রথম রাউন্ডেই তাঁর কাছে নক আউট হয়ে যান তৎকালীন সময়ের অন্যতম ফরাসি বক্সার রেনে ডেসমারিয়াস। প্রায় এক বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারে সমস্ত ম্যাচেই অপরাজিত ছিলেন বেলমন্দো। 

আরও পড়ুন
কে বন্ধু, কে বন্ধু নয়— জানতে মৃত্যুর অভিনয় করেছিলেন মার্কিন কোটিপতি!

তবে বক্সিং রিং-এ অপ্রতিরোধ্য হলেও, স্কুলের মাঠে সহপাঠীদের সঙ্গে মারামারিতে নাকের হাড় ভেঙেছিল বেলমন্দোর। তারপরেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। তাঁর অভিনীত মিশেল চরিত্রের মতোই হঠাৎ পথবদল। পরবর্তীতে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, আয়নার নিজের প্রতিচ্ছবিই তাঁকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিল এই লড়াইয়ের পটভূমি থেকে। তবে বক্সিংকে বিদায় জানালেও ‘যুদ্ধ’ থামল না। বাধ্যবাধকতা মেনেই সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে হয়েছিল বেলমন্দোকে। আলজিরিয়ায় বছর খানেক সেনাবাহিনীর হয়ে কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। যেতে হয়েছে কঠোর অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই।

আরও পড়ুন
গুণমুগ্ধ ছিলেন সত্যজিৎ-উত্তমের, অভিনয়ের তাগিদে শিখেছেন বাংলা ভাষাও

অভিনয় জগতে প্রবেশ তারও পরে। নাটক দেখার নেশা থেকেই ভর্তি তিনি হয়েছিলেন একটি বেসরকারি ফরাসি ড্রামা স্কুলে। ১৯৫৩ সালে সেই স্কুলের সূত্র ধরেই প্রথম মঞ্চ অভিনয়। তারপর প্যারিস ট্যুর। সিনেমায় অভিনয় শুরু তারও বছর তিনেক পর। ‘মলিএর’ সংক্ষিপ্ত ছবিতে প্রথম দেখা যায় তাঁকে। তারপর ১৯৫৮ সালে মার্সেল অ্যালবার্ট কার্নির জোড়া ছবি ‘ইয়ং সিনার্স’ এবং ‘বি বিউটিফুল বাট শাট আপ’-এর দৃশ্যায়নে। 

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্রে প্রথম ও শেষ অভিনয় সৌমিত্রের সঙ্গে, সাত মাসের ব্যবধানে প্রয়াত স্বাতীলেখাও

তবে চলচ্চিত্রে নবজন্ম হয়েছিল গদারের হাত ধরেই। ‘ব্রেথলেস’-এ। তাঁর মধ্যেকার সত্তাটাকেই যেন পর্দায় তুলে এনেছিলেন গদার। আর ক্যামেরার সামনে নিজেকে সবটা উজাড় করে দিয়েছিলেন বেলমন্দো। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। স্টারডমের শুরু সেই থেকেই। তারপর ‘লেটার বাই আ নভিস’, ‘সেভেন ডেস, সেভেন নাইটস’, ‘লাভমেকারস’ ‘প্রিস্ট’… তালিকাটা শেষ হওয়ার নয়। ভাঙা নাকের সেই দামাল ছেলেটা কখন যে আইকন হয়ে উঠেছিল ষাটের দশকে, তা বুঝতেও পারেনি ফরাসি দর্শক। 

তবে এই অভিনয় জীবনের ফের পথ পরিবর্তন হয় ১৯৮৭ সালে। বড়ো পর্দা ছেড়ে ফের মঞ্চকে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই বেছে নেন জঁ-পল। একাধিক উল্লেখযোগ্য নাটকের মঞ্চায়ন এবং প্রযোজনাও করেছেন তিনি অভিনয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। প্রথম ফরাসি কল্পবিজ্ঞান-কমেডি নাটক ‘পুয়েত্রে’ যার মধ্যে অন্যতম। 

সব মিলিয়ে বলা চলে, ফরাসি ও বিশ্ব চলচ্চিত্র এবং অভিনয়কে এক নতুন মোড় নিয়েছিল তাঁকে কেন্দ্র করেই। ব্রেথলেসের পরে মিশেলকে অনুকরণ করেই জন্ম নিয়েছিল হাজারো ভঙ্গুর, বিষণ্ণ চরিত্র। বেলমন্দোর চলে যাওয়ায় সেই দীর্ঘ ইতিহাসেই যেন ছেদ পড়ল…

Powered by Froala Editor