প্যারালিম্পিকে প্রথম বাঙালি পদকজয়ী, চেনেন মনোজ সরকারকে?

বয়স তখন মাত্র বছর দেড়েক। আর ওইটুকু বয়সেই তাঁকে মাশুল গুনতে হয়েছিল ভুল চিকিৎসার। ডান পায়ের গোড়ালিতে অস্ত্রোপচারের ভুলে পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। লড়াইয়ের শুরু সেই থেকেই। জীবন নিয়েও টানাটানি হয়েছিল যমে-মানুষে। শেষ অবধি প্রাণ বাঁচলেও কর্মদক্ষতা হারায় তাঁর ডান পা। কিন্তু তারপরেও লড়াকু মানসিকতা হারাননি তিনি। বরং, বিশ্বজয়ের দৌড়ে নেমেছিলেন ইচ্ছাশক্তির জোরে। মনোজ সরকার। গত ৪ সেপ্টেম্বর টোকিও প্যারালিম্পিকের মঞ্চে এই বঙ্গসন্তানই ভারতকে এনে দিয়েছেন ১৭তম পদক। উল্লেখ্য, এটাই বাঙালির প্রথম অলিম্পিক পদকজয়।

ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরেও যে একটা মস্ত বড়ো ক্রীড়াজগৎ আছে, তার খবর আর ক’জনই বা রাখেন। তাও যদি আবার প্যারা-গেমস হয়। ঠিক সেভাবেই প্যারা-ব্যাডমিন্টনের অস্তিত্বের ব্যাপারেও ন্যূনতম জানতেন না বাঙালি ক্রীড়াপ্রেমীরা। বছর তিনেক আগের কথা। অর্জুন পুরস্কার পাওয়ার পর মনোজের গলাতেই শোনা গিয়েছিল সেই আক্ষেপের সুর, ‘সাইনা-সিন্ধু-শ্রীকান্তদের কথা আমি জানলেও, তাঁরা হয়তো আমার কথা জানেন না।’ একথা যে একশো শতাংশ সত্যি, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই কোনো। অথচ, তাঁর ঝুলিতেই রয়েছে একাধিক জাতীয় মিটের পুরস্কার। রয়েছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দু’-দুটি স্বর্ণপদক-সহ একাধিক মেডেলের লম্বা ট্যালি। আর সেই তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন প্যারালিম্পিক ব্রোঞ্জ। 

শনিবার প্যারা-ব্যাডমিন্টনের এসএল৩ বিভাগের তৃতীয় স্থানের ম্যাচে জাপানের দাইসুক ফুজিহারাকে দুটি সেটেই পরাজিত করেন মনোজ। জিতে নেন ব্রোঞ্জ। তবে তাঁর হয়তো কথা ছিল প্যারালিম্পিক ফাইনাল খেলারই। বিশ্ব র্যা ঙ্কিং-এ দীর্ঘদিন প্রথম স্থান ধরে রাখার পরেও, প্যারালিম্পিকে অল্পের জন্য হাতছাড়া হয় ফাইনালের টিকিট। ভাগ্য সায় দেয় সেমিফাইনালে। 

জন্মগতভাবে বাঙালি হলেও, মনোজের জন্ম উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুরে। বাবা ছিলেন রংমিস্ত্রি। কাজের সূত্রেই বছর চল্লিশেক আগে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন সেখানে। পরবর্তীতে সেখানেই বিবাহ করে সংসার পারেন তিনি। অল্প বয়সেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে কর্মক্ষমতা হারান মনোজের বাবা। আর তারপরেই শুরু হয়েছিল আর্থিক অনটনের সঙ্গে লড়াই। দু’বেলা পুষ্টিকর খাবার জুটত না মনোজদের। তার ওপর চিকিৎসার খরচ তো ছিলই। এসবের মধ্যে

আরও পড়ুন
প্যারালিম্পিকে সর্বকালের সেরা ফলাফল, পদক পেলেন কারা?

তবে এতকিছুর পরেও হাল ছাড়েননি মনোজ। বরং, আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই দাপিয়ে বেড়াতেন খেলার মাঠে। হাতে তুলে নিয়েছিলেন র্যা কেট। সেই দৌড়টাই যে কখন তাঁকে অলিম্পিকের মঞ্চে পৌঁছে দেবে, তা বোধহয় জানতেন না নিজেও।

আরও পড়ুন
৫৩ বছর বয়সে সোনা জিতে চমক ডাচ প্যারালিম্পিয়ানের

তবে সাফল্য এলেও, আর্থিক অবস্থা বদলায়নি খুব একটা। বছর কয়েক আগে দুঃখের সঙ্গেই মনোজ জানিয়েছিলেন, প্যারা-অ্যাথলিটদের জন্য কোনোরকম অনুদানের বন্দোবস্ত রাখেনি উত্তরাখণ্ড সরকার। ফলে, লখনৌতে খরচসাপেক্ষ ট্রেনিং করাই তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল কঠিনতম কাজ। বাংলায় না থাকতে পারার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন তিনি। তবে প্রথম বাঙালি হয়ে প্যারালিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ের পর সেই খরা কাটবে বলেই আশাবাদী মনোজ। আশাবাদী, আগামীতে আপামর বাঙালির সমর্থনও থাকবে তাঁর পাশে পাশেই…

আরও পড়ুন
বোমা-বিস্ফোরণে পা হারিয়েও অশ্বারোহণ, প্যারালিম্পিকে রূপকথা লিখছেন বেয়াত্রিচে

Powered by Froala Editor