‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ – বর্ণবৈষম্য মুছে আমেরিকাকে ‘মানুষ’ করতে চেয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং

আমেরিকা এখনও জ্বলছে। প্রতিটা রাস্তায় গর্জে উঠছে একটাই আওয়াজ- ‘আই কান্ট ব্রিথ’। করোনা ভাইরাস এখনও থাবা সরায়নি; আমেরিকায় এমনিই চলছে মৃত্যুমিছিল। তাও ঘরে বসে থাকেননি কেউ। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু সবার মনের ক্ষোভ, রাগকে সামনে নিয়ে এল। বর্ণবিদ্বেষ কি শুধুই সাদা-কালোয় আটকে আছে? একজন মানুষের অধিকার, স্বাভাবিকভাবে সমাজে বেঁচে থাকার অধিকারকেও তো মেরে দেওয়া হয়। তবে শুধু আজ নয়, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এর আগেও বহুবার উত্তাল হয়েছে পৃথিবী। আমেরিকা তো বটেই, অন্যান্য জায়গাও দেখেছে কালো মানুষদের আওয়াজ। মানুষের অধিকারের পক্ষে যে আওয়াজ বারবার গলা তুলেছে।

বর্ণবৈষম্যের উদাহরণ আমাদের রোজকার জীবনে হামেশাই দেখতে পাই। সেই দেখাটা শুরু হয়েছিল চোদ্দ-পনেরো শতক থেকেই। কালো মানুষদের প্রায় কেউই ‘মানুষ’ বলে মনে করত না। যেন ভিনগ্রহের প্রাণী তাঁরা। কেবল এবং কেবলমাত্র দাসবৃত্তির কাজই যেন এই মানুষগুলোর নিয়তি। সঙ্গে চলত অত্যাচার, খুন। ঝাঁ-চকচকে আমেরিকা তৈরি হওয়ার আগে, ইউরোপে এর প্রচলন শুরু হয়। আমেরিকার দ্বীপগুলোয় যে আদিবাসীরা থাকত, তাদের নিয়ে এসে শ্রমিক বা দাস হিসেবে বিক্রি করা হত ইউরোপে। সঙ্গে আফ্রিকা তো ছিলই। এই সবের বিরুদ্ধে সর্বসমক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন আন্তোনিও ডে মন্টেসিনোস নামের এক স্প্যানিশ যাজক। সালটা ছিল ১৫১১; বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছিল তখন থেকেই। 

তবে এই বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে প্রবলভাবে যুক্ত ছিল সেই যুগের চার্চ। শুধু কালো নয়, ‘মুলাটো’ অর্থাৎ যাদের অভিভাবকদের একজন কালো আরেকজন ফর্সা চামড়ার, তাঁদেরও একই সমস্যার মুখে পড়তে হত। যাজকদের যুক্তি ছিল, যদি ওই মানুষগুলো খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে, তবেই একমাত্র মূল স্রোতে আসতে পারবে। এবং স্রেফ এই কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ইউরোপীয় ধর্মযাজকরা পৌঁছে গেল জাহাজে করে। সে আফ্রিকা হোক, কিংবা আদিম আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া। অবশ্য এমন বাঁচার রাস্তাটি পেয়ে অনেকেই যুক্ত হয় এর সঙ্গে … 

ভারতের দিকে তাকালেও একই জিনিস দেখা যায়। ব্রিটিশ শাসনের সময় স্পষ্টত দুটো ভাগে ভাগ ছিল এখানকার সমাজ। সামনে উঠে আসে ‘নেটিভ’, ‘নিগার’, ‘নিগ্রো’ এই শব্দগুলো। এমনিই জাতপাতের ঘৃণ্য প্রথা এই দেশে প্রচলিত ছিলই; তার সঙ্গে যুক্ত হল গায়ের রংও। মানুষের অধিকার যেন খোলামকুচির মতো হারিয়ে যেতে লাগল। ইতিমধ্যে আফ্রিকার ভেতরেও পৌঁছে যেতে লাগল ইউরোপীয়রা। দাস প্রথা রমরমিয়ে বেড়ে চলল। কত মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলা হয়েছে তার ঠিক নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর আন্দোলনই বলুন, বা অষ্টাদশ শতকে ‘কোয়াকার’দের আন্দোলন— ছোটো ছোটো জায়গা থেকে প্রতিবাদ চলছিলই। 

আরও পড়ুন
গৃহহীন মানুষদের জন্য রাস্তাতেই হাত পরিষ্কারের ব্যবস্থা আমেরিকায়

আমেরিকাতেও দাসপ্রথা ও বর্ণবৈষম্যের বীজ ঢুকে পড়ছিল একটু একটু করে। মোটামুটি ১৭শ শতক থেকেই বিভেদ শুরু হতে থাকে সেখানে; যা বীভৎস আকারে যেতে থাকে। কিন্তু প্রতিবাদ করার জোর বা সাহস কোনোটাই ছিল না তাঁদের। আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে আসা হয় আমেরিকায়, স্রেফ কাজের জন্য। এমনকি এই পৃথিবী দেখেছে কালো মানুষদের নিয়ে তৈরি চিড়িয়াখানাও। আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা রদ করলেও, মানুষের মনের ভেতর থেকে দাসপ্রথা যায়নি। বর্বরতার সীমা পেরনোর পর প্রতিরোধ এল একদিন। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় তখন। আমেরিকার আলাবামায় রোজা পার্কস নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে বাস থেকে ধাক্কা নামিয়ে দেওয়া হয়, সেইসঙ্গে দিতে হয় জরিমানা। কারণ? তিনি বাসে এক শ্বেতাঙ্গকে সিট ছেড়ে দেননি। নিজের অধিকার বজায় রেখেছিলেন। সেটা তাঁকে রাখতে দেওয়া হল না… 

আরও পড়ুন
আবারও কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার নির্মম ঘটনা আমেরিকায়, প্রতিবাদে রাস্তায় নামল মানুষ

এরপরই আমেরিকায় প্রবলভাবে শুরু হল অ্যান্টি-রেসিজম আন্দোলন। অনেক সহ্য হয়েছে, আর নয়। রোজা পার্কস তো আন্দোলনের মুখ হলেনই, সেইসঙ্গে উঠে এলেন আরও একজন। যাকে ছাড়া এই আন্দোলন, এই আলোচনা ভাবা যায় না। হ্যাঁ, ডঃ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। বাস ধর্মঘট, বিশাল মিছিল তো হলই। সঙ্গে তোলা হল আওয়াজ, কালো মানুষদের অধিকারের আওয়াজ। ইতিমধ্যেই পঞ্চাশের দশকে আমেরিকায় আটটা কৃষ্ণাঙ্গদের চার্চে বোমা ফেলে কয়েকজন। আগুন আরও জ্বলে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আলাবামায় বাস থেকে উঠে গেল বর্ণবিদ্বেষের ছায়া। আইন এল, এবার থেকে সাদা-কালো বিভেদ থাকবে না। এই প্রথম একটা বড়ো জয় এল আন্দোলনে। মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণে সেই জোরের জায়গা খুঁজে পেল মানুষ। আজকের ‘আই কান্ট ব্রিথ’-এর মতো আরও একটা কথা প্রবাদ হয়ে গেল। মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা- ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’… 

আরও পড়ুন
তিনটে পা ও ১৬টি আঙুল নিয়েই আমেরিকা মাতিয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক, শিখেছেন ফুটবলও

একবার ভালো করে ভাবলে, এই আন্দোলন কীসের? সাদা বিশ্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন? তা তো নয়! প্রতিটা মানুষ যেন নিজের অধিকারটুকু ভোগ করে। তাঁর পরিচয় যেন তৈরি হয় কাজে; লিঙ্গ-বর্ণ-জাত-পাত-ধর্ম হিসেবে নয়। মানুষ বেঁচে থাকুক মানুষ হিসেবে। কিন্তু আজও কি সেই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি? দাসপ্রথা মুছে গেছে, কালো মানুষদের অধিকার রক্ষায় নানা আইন এসেছে; মহম্মদ আলি, ওপরা উইনফ্রে, বারাক ওবামা, মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষরা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন এখনও। আজও কত মানুষ নিজের কাজে বিশ্বসেরা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভেতর থেকে কি বিভেদরেখা মুছেছে? এমনই এক বাস্তবতার সামনে আমাদের আনলেন জর্জ ফ্লয়েড। তাঁর মৃত্যু আমাদের জানাল, বদলায়নি এখনও। বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষ নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর তা শুরু হচ্ছে ছোটো বয়স থেকেই। ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যায় আমাদের। প্রতিবাদ তো শুধু কালো মানুষদের জন্য নয়; মানুষের অধিকারের জন্য। রাষ্ট্রের বর্বরতার জন্য… 

আরও পড়ুন
রেমডিসিভির নিয়ে গবেষণার মূলে এক বাঙালি অধ্যাপক, ব্যবহারে ছাড়পত্র আমেরিকার

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
আমেরিকার বোমায় বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম, যুদ্ধের দিনে ত্রাণ পাঠাল সেই ‘শত্রু’ দেশেই

Latest News See More