ঢাকার 'ঢাকেশ্বরী' চলে এলেন 'প্রবাস' কলকাতায়, দেশভাগে ছিন্নমূল দেবীও

সাল ১৯৪৮। সদ্য পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছে একটি দেশ। থুড়ি, একটি নয়, দুটি। স্বাধীনতা এলেও রাতারাতি ভেঙে খানখান ভারত। তৈরি হল পাকিস্তান। স্বাধীনতার সেই ‘শুভ’ মুহূর্তেই নেমে এল লাখ লাখ ভিটেছাড়া মানুষের ভিড়। রক্তে ভেসে গেল অবিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাবের মাটি। এমন দাঙ্গার দিনই কি দেখতে চেয়েছিল মানুষগুলো? এই ছবির মাঝখানেই কাঁটাতারের এপার ওপারে নেমে পড়ল উদ্বাস্তুদের ঢল। মাথার ওপর ছাদ নেই, খাবার নেই। বাংলাও শান্ত হয়নি তখন। এমন সময় ঢাকা থেকে একটি বিশেষ বিমান উড়ে এল কলকাতার বুকে। এত তৎপরতা কীসের? কে আছেন ওই বিমানে? উৎসাহ বেড়েই চলল। শেষ পর্যন্ত বিমান থেকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে নামলেন আসল ‘মানুষ’টি। ঠিক মানুষ নয়, বলা ভালো স্বয়ং ভগবান! দেশভাগ আর দাঙ্গার ‘বলি’ তিনিও। সেই ঢাকা থেকে উড়ে এসে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন ‘ঢাকেশ্বরী মাতা’। আর তার জন্যই তৈরি ছিল সেই বিশেষ বিমান… 

উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চল। দুর্গাপুজো তো বটেই, বছরের অন্যান্য সময়ও বেশ ব্যস্ত থাকেন এখানকার মৃৎশিল্পীরা। ঈশ্বর এখানে মৃন্ময়ী রূপ নিয়ে হাজির থাকেন। তবে এর বাইরেও হাজির হয় ইতিহাস। ঘুরতে ঘুরতে একসময় হাজির হয় মদনমোহন জীউ মন্দির। এর কাছেই সেই ‘ঐতিহাসিক’ ঢাকেশ্বরী মাতার অধিষ্ঠান। প্রায় দেড় ফুট লম্বা দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী হাজির হয়েছেন তাঁর সন্তানদের নিয়ে। অসুরের সামনে থাবা বাড়িয়ে হাজির পৌরাণিক সিংহও। গাত্রবর্ণ সোনালি; তবে সোনা কিনা জানা যায় না। তবে পেছনের চালচিত্রটি রুপোর। আর এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৮০০ বছরেরও বেশি সময়ের একটি ইতিহাস। আর জড়িয়ে রয়েছে দেশভাগ। যার জেরে কুমোরপাড়ায় ঠাই নিয়েছেন ঢাকেশ্বরী দেবী… 

কবে দেবীমূর্তির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর মতভেদ। তবে একটি নাম সেইসব কাহিনির মধ্যে দিয়ে বারবার উঠে আসে। তিনি সেনবংশের রাজা বল্লাল সেন। ঢাকায় স্থানীয় যে গল্পটি প্রচলিত রয়েছে, তার সঙ্গেই জুড়ে আছেন তিনি। রাজা বিজয় সেন তখন মসনদে। সেন বংশের শাসন চলছে বাংলা জুড়ে। একদিন রাজার স্ত্রী লাঙ্গলবন্দে যাচ্ছিলেন স্নান করতে। হঠাৎই ওঠে প্রসববেদনা। পথের মধ্যেই, এক জঙ্গলের মধ্যে পুত্রসন্তান প্রসব করেন তিনি। পরবর্তীকালে সেই সন্তানই হয়ে ওঠেন বল্লাল সেন। কথিত আছে, রাজা হওয়ার পর সেই জঙ্গল থেকেই ঢাকেশ্বরী দেবীমূর্তি উদ্ধার করেন তিনি। এবং নিজের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁকে। ইতিহাস দেখলে সহজেই অনুমেয়, এই ইতিহাস ৮০০ বছরেরও বেশি আগের। তখন থেকে ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দিরই হয়ে উঠেছিল দেবীর আরাধ্য জায়গা। 

হয়ত সেখানে আজও নিজেকে ধরে রাখতেন তিনি। কিন্তু সময়ের ঢেউ যে সবসময় মোলায়েম হবে, এমনটা তো নয়। পরাধীনতার জ্বালা তো ছিলই গোটা দেশে। একটাই লক্ষ্য ছিল সবার— স্বাধীনতা। দুশো বছর শাসন করার পর ইংরেজরাও বুঝছিলেন, তাঁদের জায়গা ফুরিয়ে গেছে। ভারত থেকে চলেই যেতে হবে। কিন্তু স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে কে বসবে? শুরু হল দ্বন্দ্ব। এই সুযোগটাই কি খুঁজছিল ব্রিটিশরা? ১৯০৫ সালে একবার ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এবার, গোটা দেশটাই ভাগ করা হবে! আর এমন পরিস্থিতিতেই শুরু হল দাঙ্গা। কলকাতা, বিহার, পাঞ্জাব, নোয়াখালী, ঢাকা— সর্বত্র জ্বলে উঠল। রাস্তায় রাস্তায় আগুন জ্বলছে, পড়ে আছে প্রতিবেশীর ক্ষতবিক্ষত দেহ। এপারের পাশাপাশি রক্ত ঝরল ওপারেও। 

সেইসঙ্গে শুরু হল লুঠতরাজ। বাড়ি-ঘর থেকে ধর্মস্থান— কিছুই বাদ গেল না। এমন কালো সময়ের মধ্যে দিয়েই চলে এল ১৯৪৭-এর আগস্ট মাস। প্রথমে পাকিস্তান, তারপর ভারত স্বাধীনতা লাভ করল। আর পাঞ্জাব, বাংলার দুই প্রান্তই ভরে উঠতে লাগল উদ্বাস্তুদের ভিড়ে। রাতারাতি ভিটেমাটি উজাড় হয়ে গেছে, কেউ আবার পরিবারকেই খুঁজে পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ল ঢাকেশ্বরী মন্দিরও। যতই ঢাকার ঐতিহ্য হোক না কেন, এমন উত্তপ্ত সময় যদি বিগ্রহকে রক্ষা করা না যায়! তৎপর হয়ে উঠলেন সেখানকার সেবাইতরা। শোনা যায়, মানসিং নাকি আজমগড়ের এক পরিবারকে এই দেবীর সেবাইত হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। বংশপরম্পরায় তাঁরা সেই কাজই করে আসছেন। তাঁদেরই বংশধর বিগ্রহটিকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেন। ঠিক হল, ঢাকেশ্বরী মাতার জন্যই একটি বিশেষ বিমানের আয়োজন করা হবে। গন্তব্য কলকাতা। অত্যন্ত গোপনেই শুরু হল আয়োজন। ১৯৪৮ সাল। তখনও শান্ত হয়নি পরিবেশ। তার মধ্যেই বিমানে করে ঢাকেশ্বরী মাতার বিগ্রহটিকে নিয়ে আসা হল কলকাতায়… 

লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে দেবী ঢাকেশ্বরীও তখন উদ্বাস্তু। এত বছরের পীঠস্থান থেকে সরে এলেন তিনি। এবার কোথায় জায়গা পাবেন? কলকাতার ব্যবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাড়িতে স্থান পান তিনি। সেখানেই নিত্যপূজা সম্পন্ন হয় তাঁর। কিন্তু স্থায়ী একটা মন্দির তো থাকা দরকার। ব্যবস্থা করলেন দেবেন্দ্রনাথই। কুমোরটুলি অঞ্চলে নিজের উদ্যোগেই তৈরি করলেন মন্দির। ১৯৫০ সালে সেই মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত হন ঢাকেশ্বরী মাতা। আজও সেই মন্দিরেই তাঁর অধিষ্ঠান। কয়েকশো কিলোমিটার দূরে ঢাকার বুকে এখনও দাঁড়িয়ে আছে সেই আদি মন্দিরটি। সেখানে ঢাকেশ্বরী মাতার মতো একই রকমের অন্য একটি বিগ্রহ রেখে পুজো করা হচ্ছে। তাতে কি আর উদ্বাস্তু ক্ষত মেটে? দুর্গামূর্তি, দেশভাগ আর কলকাতা কোথাও যেন একসঙ্গে জুড়ে যায় এখানে। স্বয়ং ভগবান কি সেই দুঃখ ভুলতে পারেন… 

আরও পড়ুন
পরাধীনতার হতাশা মণ্ডপজুড়ে, সুভাষচন্দ্রের সভাপতিত্বে সেই প্রথম থিমপুজো কলকাতায়

তথ্যসূত্র- 

১) ‘কলকাতা কড়চা’, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, আনন্দবাজার পত্রিকা 

২) ‘অনাদৃত রত্ন ৪৭: ঢাকেশ্বরী মাতা মন্দির, কুমারটুলি’, আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়, কৌলাল 

আরও পড়ুন
ঘরে এল আই-লিগ ট্রফি, সবুজ-মেরুন জোয়ার কলকাতায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More