ভাঙা গোড়ালি নিয়েই মেলবোর্নে জেতালেন দোশী, রুম নাম্বার চেয়েছিলেন বিরক্ত মিয়াদাঁদও

তিরিশের পরে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পর মাত্র চারজন বোলারই এখনও অবধি পেরোতে পেরেছেন ১০০ উইকেটের গণ্ডি। কিন্তু তার মধ্যেও এক বাঁ-হাতি ভারতীয় স্পিনার ছিলেন স্বতন্ত্র। দিলীপ বেঙ্গসরকার থেকে শুরু করে কপিল দেব, এরাপল্লি প্রসন্ন কিংবা বিষেণ সিং বেদি, সবার কাছেই অত্যন্ত ‘হাই মার্কস’ পেয়ে এসেছেন যিনি সব সময়। কিন্তু সর্বকালের অন্যতম সেরা বাঁ-হাতি বোলার বিষেণ সিং বেদি স্বয়ং খেলছেন তখন ভারতীয় দলে। তাঁর সঙ্গে প্রসন্ন, ভাগবত চন্দ্রশেখর, শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন। সুতরাং চারপাশে এত তারকাদের ভিড়ে তাঁর জাতীয় দলে সুযোগ পেতে পেতেই কেটে গেল ৩২টা বছর। কিন্তু বয়স কবেই বা আর থামাতে পেরেছে প্রতিভাকে? সেই প্রথম টেস্টেই নিলেন আট উইকেট। সবথেকে বেশি বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেককারী হিসেবে সেই ভদ্রলোক, অর্থাৎ, দিলীপ দোশীর সেই রেকর্ড অটুট এখনও।

যদিও অনেক বেশি বয়সে ভারতীয় দলে সুযোগ পেলেও, অন্য একটি দিক থেকে সৌভাগ্যবানই বলতে হবে তাঁকে। কারণ, তিনি অন্তত দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সময় ভারতীয় দলে স্পিনারদের সুযোগ পাওয়া এতটাই কঠিন ছিল যে, অসম্ভব প্রতিভা নিয়েও দলে জায়গা পাননি পদ্মাকর শিভালকর এবং রাজিন্দার গোয়েলের মতো বোলার, যিনি কিনা রঞ্জি ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীও বটে! যদিও সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগাতে দেরি করেননি দিলীপ দোশী। ১৯৭৯। দেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ। প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। চেন্নাইয়ে অভিষেক টেস্টেই অসাধারণ বোলিং করে দুই ইনিংস মিলিয়ে প্রতিপক্ষের আটটি উইকেট ঝুলিতে ভরলেন তিনি।

কিন্তু তবুও চার বছরের বেশি ভারতীয় ক্রিকেট দলে টিকে থাকতে পারেননি দোশী। তবে সৌরাষ্ট্রের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হলেও, নিজের সম্পূর্ণটা উজাড় করে দিয়েছেন পরবর্তীতে বাংলার হয়ে মাঠে নেমে। ৩১৮টি রঞ্জি উইকেট দিলীপ দোশীর পক্ষে কথা বললেও, ব্যাটিংয়ে কিন্তু সেরকম ভাবে মন দিয়ে উঠতে পারেননি কখনোই। এদিকে দলে তারুণ্য কে না চায়? ফলে প্রথমে মনিন্দর সিং এবং তারপর রবি শাস্ত্রীর আগমন ঘটলে, জাতীয় দলের কক্ষ থেকে ক্রমশই দূরে সরে যেতে থাকেন দোশী।

১৯৮৩। পাকিস্তান খেলতে এল ভারতে। সেই সময় তারকা বলা হচ্ছে যাঁকে, সেই জাভেদ মিয়াঁদাদকে অতিষ্ঠ করে তুলল দোশীর বোলিং। দোশীকে মিয়াঁদাদ জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার রুম নাম্বার কত? ওখানে মারবো!” তবে দোশীর সঙ্গে পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদের বাক্যালাপ যতটা প্রচার পেয়েছে মিডিয়াতে, তার থেকে আরও একটু অন্যভাবে কিন্তু আমরা মনে রাখতেই পারতাম ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা প্রতিভাকে। কিন্তু জীবন কখনই বা আর এমন সরল পথে চলেছে?

আশ্চর্যজনকভাবে ভারতীয় দলের অনেক উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত নিয়ে বিশদ আলোচনা হলেও, ১৯৮১ সালের মেলবোর্নে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচ নিয়ে কখনোই কথা হয় না সেরকম। অথচ ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সেই ম্যাচের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ভারতীয় দলের বিশ্বকাপ হাতে তোলার বছর দুই আগেই হয়েছিল নতুন একটা ইতিহাস। সিরিজে ইতিমধ্যেই ১-০ পিছিয়ে রয়েছে ভারতীয় দল। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় সফরকারী দলের পক্ষে সেটা আর তখন কোনও নতুন ছবি নয়! চ্যাপেল ভাই, অ্যালান বর্ডার, টমসন— একের পর এক তারকা নিয়ে ক্রিকেট মাঠে তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অস্ট্রেলিয়া দল। এই অবস্থায় পিছিয়ে থেকে মেলবোর্নের মতো মাঠে সফরকারী দলের সমতা ফিরিয়ে আনার লড়াই যে ঠিক কতটা কঠিন, তা ক্রিকেট রসিক মাত্রই বুঝবেন। কিন্তু এই ম্যাচটির জন্যই অমর হয়ে থাকতে পারতেন দিলীপ দোশী। যেখানে টেস্ট সিরিজ শেষে ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘দিলীপ শিখিয়ে গেলেন বুদ্ধিদীপ্ত স্পিন বোলিং ভবিষ্যতে ঠিক কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে ক্রিকেট খেলাটাকে’। অথচ সেই টেস্ট যে ভাবে খেলতে নেমেছিলেন দোশী, তা তাকে অতিমানবের থেকে কম কিছু ভাবতে বাধ্য করে না।

সেই ঐতিহাসিক মেলবোর্ন টেস্টেr তিন দিন আগেই একটা প্র্যাকটিস ম্যাচে ঘটে গেল দুর্ঘটনাটা। বিপক্ষের বোলারের ইয়র্কার আছড়ে পড়ল দিলীপ দোশীর গোড়ালিতে। চিড় ধরল গোড়ালির হাড়ে। বল করার সময় বাঁ-হাতি স্পিনারের শরীরের ওজন থাকে বাঁ-পায়ের উপরেই। সেই বাঁ-পায়ের গোড়ালিতেই ভয়ঙ্কর চোট লাগার অর্থ, অবধারিতভাবে মাঠের বাইরে এবং সোজা বিছানায়। কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া ছিলেন দিলীপ দোশী। যেভাবেই হোক ম্যাচটা খেলতে চেয়েছিলেন তিনি। দলের কেউ জানতে পারল না, দোশীর চোটের কথা; শুধু রুমমেট শ্রীনিবাসন ছাড়া। আইস প্যাক, ইঞ্জেকশন, ইলেকট্রিক শক চলল নাগাড়ে সকলের চোখের আড়ালেই। ডাক্তাররা সাবধান করলেন বারবার। কান দিলেন না দোশী। শুধু ক্যাপ্টেন গাভাসকরকে বললেন, পা’টা একটু মচকেছে; তাই তেমন জোরালো প্র্যাকটিস করবেন না। সিনিয়র ক্রিকেটারের কথায় আপত্তির তেমন কিছু ছিল না।

আরও পড়ুন
দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেগস্পিনার তিনি, বোর্ডের সঙ্গে সংঘাতে ছেড়েছিলেন ক্রিকেট

৫২ ওভার বল করলেন প্রথম ইনিংসে দোশী। নিলেন পাঁচটা উইকেট। এর মধ্যেই আসল আরও একটা দুঃসংবাদ। থাইয়ের পেশীতে মারাত্মক চোট পেলেন দলের এক নম্বর ফাস্ট বোলার কপিল দেব। শুধু সেদিনের জন্যই না, মোটামুটি গোটা টেস্টেই তাঁর আর নামার সম্ভাবনা নেই। দুর্ঘটনা পিছু ছাড়ল না সেখানেই। ব্যাটিং করার সময় শিবলাল যাদবের গোড়ালি ভেঙে দিল লেনি পাসকোর বল। সেই লেনি পাসকো, যার বলের গতি কখনও কখনও জেফ টমসনের থেকেও বেশি ছিল। অর্থাৎ কপিল দেবের পর এবার ছিটকে গেলেন দলের আরেক বোলার, অফ স্পিনার শিবলাল যাদব।

বেগতিক পরিস্থিতিতেও ঘাবড়ালেন না দিলীপ দোশী। অবশিষ্ট বোলার কারসন ঘাউড়িকে বললেন, মাঠে তো নামি। যা হবে দেখা যাবে! একশোর কিছু বেশি রান দরকার অস্ট্রেলিয়ার জেতার জন্য। দলে ইয়ান চ্যাপেল, গ্রেগ চ্যাপেল, অ্যালান বর্ডারের মতো ব্যাটসম্যান। সেই দিনের খেলা শেষ হবার আগেই ২৪ রানের মধ্যে তিনটি উইকেট পড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার। সবুজ ঘাসের স্পিন শিল্পের জাদু তৈরি করছেন দোশী তখন। এদিকে ততক্ষনে দলের সবাই জানতে পেরে গেছে দোশীর গোড়ালির চোটের খবর। সেটাই কি কোনোভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল কপিল দেবকে? আহত ঊরু নিয়েও পরের দিন কপিল দেব গাভাসকরকে গিয়ে বললেন, তিনি মাঠে নামতে রাজি! তার পরের গল্পটা ডেভিড বনাম গোলিয়াথের বিরুদ্ধে অসম লড়াইতে অদম্য জেদের জিতে যাওয়ার গল্প। আহত ঊরু এবং ভাঙ্গা গোড়ালি নিয়ে দুই বোলার ছিন্নভিন্ন করে দিল অজি ব্যাটিং লাইনআপকে। মাত্র ৮৩ রান। অলআউট অস্ট্রেলিয়া! সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ইনিংসেও দিলীপ দোশী বল করলেন ৩২ ওভার! ৫টা উইকেট নিলেন কপিল দেব।

কতটা প্যাশনের সঙ্গে, সাহসের সঙ্গে ক্রিকেটটা খেলা যায়— তার একটা অনন্য নিদর্শন যেন তৈরি হয়েছিল সেদিন। অথচ ক্রিকেটটা তারপরও কীভাবে যেন শুধু ব্যাটসম্যানদের খেলা হয়েই থেকে গেল! স্পিন শিল্পের এইসব জাদুকরদের ধীরে ধীরে ভুলতেই থাকলাম আমরা। তবে তাতে হয়ত সত্যিই কিছু এসে যায় না দিলীপ দোশীদের মতো চরিত্রদের। কারণ, পার্শ্বচরিত্র হয়েও সুযোগ পেলেই যে নায়ক হয়ে যেতে পারেন তাঁরাও, এই আত্মবিশ্বাস এবং মনের জোরটা ধরে রাখতে তো তাঁরাই শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন!

আরও পড়ুন
ক্রিকেটের বিতর্কিত ‘মানকাডিং’ তাঁর নামেই; সাদা চামড়ার রাজনীতির শিকার বিনু মানকড়?

Powered by Froala Editor

More From Author See More