তৈরি হবে ‘কোল বেল্ট’, ২৪০ বর্গ কিমি অভয়ারণ্য নিধনের নিদান গোয়া ও কেন্দ্র সরকারের

ভারতের দক্ষিণের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র গোয়া। আর সেখানেই বিগত কয়েক মাস ধরে চলছে লাগাতার প্রতিবাদ, অবস্থান। স্থানীয় মানুষ, পরিবেশকর্মী, ছাত্র, শিক্ষক সকলেই প্রায় অংশ হয়ে উঠেছেন এই আন্দোলনের। দাবি খুবই সহজ। গোয়ার জীববৈচিত্রপূর্ণ প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিক সরকার। কিন্তু কেন এই ধরনের দাবিতে সরব হয়েছেন তাঁরা? কেনই বা ক্ষতির মুখে গোয়ার প্রকৃতি?

ধরুন গোয়ার সমুদ্র সৈকত ধরেই হেঁটে চলেছেন আপনি। এমন সময় পায়ের নিচে শক্ত কালো কোনো পাথরে উপস্থিতি টের পেলেন। হাতে তুলে সেই পাথরকে দেখলেই বুঝতে পারবেন তা আসলে কয়লা। গোয়ার নদী এবং ঝর্নাগুলির মাধ্যমেই বাহিত হয়ে এমন সমুদ্রে এসে জমা হচ্ছে অত্যন্ত হালকা এই ধরণের পাথুরে কয়লা। কিন্তু কোথা থেকে আসছে এই কয়লা? উত্তর গোয়ার একমাত্র বন্দর মর্মুগাঁও পোর্ট ট্রাস্ট থেকে।

এই বন্দরের মাধ্যমেই দেশে অন্যান্য রাজ্য এবং বিদেশ থেকে কয়লার আমদানি করে থাকে গোয়া। তারপর তা রেলপথে সরবরাহ করা হয় দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে। উদ্দেশ্য তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং স্টিল প্ল্যান্টগুলিতে তার সরবরাহ করা। বর্তমানে ৯০ লক্ষ টন কয়লার আমদানি করে গোয়া। যা ২০৩০ সালের মধ্যে পরিণত হতে চলেছে ৫ কোটি ২০ লক্ষ টনে। গোয়াকেই দক্ষিণের অন্যতম ‘কোল হাব’ হিসাবে তৈরি করাই এখন উদ্যোগ সরকারের। আর সেই পরিকাঠামো গঠনের জন্যই কাটা পড়ছে চলেছে বহু গাছ। ধ্বংস হতে চলেছে ২৪০ বর্গ কিমি অরণ্য। 

পরিকাঠামো গঠন বলতে মূলত সরকারের তিনটি প্রজেক্ট— সড়কপথ সম্প্রসারণ, রেললাইন ডাবলিং এবং উচ্চ মাত্রার পাওয়ার ট্রান্সমিশনের জন্য লাইন স্থাপন। তবে গোয়ার সরকার স্পষ্টই জানাচ্ছে এর সঙ্গে কোনোরকমের যোগসূত্র নেই কয়লার। ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্যই বাড়ানো হচ্ছে রাস্তার প্রস্থ। অন্যদিকে রাজ্যের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে পাওয়ার গ্রিডের ক্ষমতা বৃদ্ধি করাই উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুন
ছাই হয়ে গেছে অরণ্য, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর

কিন্তু কারণ যাই হোক, এই প্রজেক্টের জন্য ধ্বংস হতে চলেছে জীববৈচিত্রের ভরপুর পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পরিবেশ। যা জীববৈচিত্রের দিক থেকে বিশ্বব্যপী ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রাপ্ত আটটি হটস্পটের মধ্যে একটি। এই রিজার্ভে রয়েছে ১২৮ রকমের বিরল উদ্ভিদের প্রজাতি, কয়েকশো প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, প্রজাপতি ছাড়াও রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, প্যাঙ্গোলিনের মতো প্রাণী। দুটি পিপড়ে এবং একটি বিশেষ ফড়িংয়ের প্রজাতি এই অঞ্চল ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও-ই লক্ষ্য করা যায় না। ফলে এই সমগ্র বায়োস্ফিয়ারের ধ্বংস ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে। যার পরোক্ষ প্রভাব পড়বে গোয়ার মূল ‘জীবিকা’ পর্যটনেও।

তিনটি প্রকল্পকেই বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে লকডাউনের আগেই কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকারের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন গোয়ার পরিবেশকর্মীরা। কিন্তু লাভ হয়নি তাতে। লকডাউনের ঘোষণার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনটি প্রজেক্টেই ছাড়পত্র দেয় কেন্দ্র। সম্প্রতি পর্যালোচনার জন্য পি জাভেদকারের কাছে আরও একবার দ্বারস্থ হয়েও উত্তর মেলেনি কিছু। বিষয়টির নতুন করে অনুসন্ধান করা হবে বলেই জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতে থেমে নেই প্রস্তুতির কর্মসূচি। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই শুরুও হয়ে যাবে বননিধন।

আরও পড়ুন
পশ্চিমঘাটে অরণ্যের রক্ষাকর্তা ‘সর্পদেবতা’, উন্নয়নের কোপে হারাতে বসেছে তারাই!

মানব-রাক্ষসের হাত থেকে প্রকৃতি বাঁচাতে এই এখন একমাত্র রাস্তা হিসাবে অবস্থানকেই দেখছেন পরিবেশকর্মীরা। রেললাইনের ওপরে জড়ো হয়েই দফায় দফায় আজও আন্দোলনের সামিল হচ্ছেন তাঁরা। গ্রেপ্তারও হচ্ছেন অনেকে। মহামারীর আবহে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবাদ। তবে ভবিতব্য কী, তা আজও অজানা... 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
আবর্জনার স্তূপকে ধীরে ধীরে অরণ্যের রূপ দিচ্ছেন চেন্নাইয়ের মানুষ

More From Author See More