পোকার আক্রমণে ধ্বংস হবে ইতালি, ভাইরাস দিয়েই ঠেকালেন ঘনাদা

চল্লিশের দশকের কলকাতায়, মেসবাড়ির সান্ধ্য আড্ডায় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ঘনাদা বলে চলেছেন এক উন্মাদ ইহুদি বৈজ্ঞানিকের সর্বগ্রাসী পরিকল্পনার কথা। গুল মারার এই অসামান্য প্রতিভাকে ছাপিয়ে এখানে অবশ্য-লক্ষণীয় ঘনাদার জ্ঞান, এবং, একইসঙ্গে সময়কালও। বিশের দশকের মধ্যভাগে জার্মানিতে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির উত্থানের পর সমগ্র জার্মানি তথা ইউরোপ জুড়ে গড়ে ওঠা ইহুদি-বিদ্বেষ ও তার ভয়াবহ প্রতি-পরিণতি কেমন হতে পারে, একটি ‘পোকা’-কে কেন্দ্র করে, সে গল্পই রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন স্বনামখ্যাত ঘনশ্যাম দাস। তিনি বলছেন -

আরও পড়ুন
মহামারী রুখতে পথে রবীন্দ্রনাথ, ঘরছাড়া জগদীশচন্দ্র; মারা গেল অবনীন্দ্রনাথের ছোট্ট মেয়ে

‘তাঁর প্রথম লক্ষ্য ইটালি। দুদিন পরেই ছ’হাজার বর্গমাইল ব্যাপী এক ঝাঁক পোকা তিনি উড়িয়ে দেবেন ইটালিতে। তারপর একটা শ্যাওলার ছোপও কোথাও থাকবে না। ইটালির পর জার্মানি ও ইংল্যান্ডে কী ভাবে তিনি তাঁর অজেয় বাহিনী পাঠাবেন, সব নাকি তাঁর ছক-বাঁধা আছে। আফ্রিকার এই অঞ্চলে সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়ার জন্মস্থান খুঁজে বার করে তিনি এমনভাবে তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে নিজের পরিকল্পনা-মাফিক তৈরি করেছেন যে, ইউরোপ দশ বছর সমস্ত অস্ত্র দিয়ে যুঝেও তাদের শেষ করতে পারবে না।’

আরও পড়ুন
দেশভাগ মানতে পারেননি, লেখালিখির তাগিদে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর

বস্তুত, নাৎসি পার্টির উত্থানের সময় থেকেই দেশের অ-জার্মান মানুষজন আঁচ করতে পারছিলেন সম্ভাব্য বিপদের আভাস। এরপর নাৎসি পার্টি ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর কীভাবে রচিত হল ইহুদি থেকে শুরু করে জিপসি ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ভাগ্য, সেই কদর্য ইতিহাস সকলেরই জানা। ঘনাদার এই গল্পের সময়কাল কিন্তু সামান্য আগের। তাঁর কথা অনুযায়ী, ১৯৩১ সালের ২২ ডিসেম্বর। লাটভিয়ার রাজধানী রিগা শহরের বরফাবৃত রাস্তায় কেবল একটি হাফ সোয়েটার পরে ঘুরে বেড়ানোর ক্যারিশমা দেখে তাঁকে চিনে ফেলে জার্মান সেনা আধিকারিক জেনারেল ভরনফের এক অনুচর। ভরনফ যে আসলে ইহুদি, সেকথা সেদিনই জানতে পারেন ঘনাদা। ভরনফের সহোদর ভাই জ্যাকব রথস্টাইন ইহুদি-বিদ্বেষের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যে মারণযজ্ঞের আয়োজন করছে, সেই পরিকল্পনা বানচাল করতে ঘনাদা আফ্রিকা পাড়ি দেন। তাঁর হাতিয়ার ছিল এক ভাইরাস। সেই ভাইরাস দিয়েই ইউরোপকে ধ্বংসের হাত থেকে ঠেকিয়েছিলেন ঘনাদা।

আরও পড়ুন
মহামারীতে ছারখার বাংলা, মৃত ৫০ হাজারেরও বেশি, বাদ গেল না সাহেবরাও

ঘনাদার বিভিন্ন গল্প লেখার পিছনে প্রেমেন্দ্র মিত্রের মূল পরিকল্পনাই ছিল নানা আঙ্গিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা। ঘনাদার প্রথম গল্প ‘মশা’ প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিসমাপ্তির অব্যবহিত পরেই, দেব সাহিত্য কুটিরের আলপনা পত্রিকার ১৩৫২ পূজাবার্ষিকী সংখ্যায়। এরপর প্রতিবছরই আলপনার পূজাবার্ষিকী সংস্করণে একটি করে ঘনাদার গল্প লিখতে থাকেন তিনি। ‘মশা’ এবং ‘পোকা’ নামদুটি থেকেই কিঞ্চিৎ আন্দাজ করা যেতে পারে, যে, জীবরসায়নের একটি বিশেষ শাখাকে নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু ঘনাদার মতো একজন লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রকে দিয়ে এমনভাবে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, যে সেখানে বিজ্ঞানের গুরুগম্ভীর আলোচনাকে ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছে তৎকালীন পৃথিবীর কদর্য অস্থিরতা। বিজ্ঞান সেখানে থাকছে সূক্ষ্মভাবে। জৈবিক অস্ত্র, যা কিনা আপাতভাবে নিরীহ, কিন্তু সাধারণ বোমা-বন্দুকের চেয়ে অতীব ভয়ঙ্কর, সেই জৈবিক অস্ত্রের কূট প্রয়োগ হয়ে উঠেছে তাঁর প্রথম দুটি ঘনাদা-কাহিনির বিষয়।

আরও পড়ুন
ভারতে এসেই মার্কেজ বেপাত্তা, চিন্তিত ফিদেল কাস্ত্রো, পথে নামল পুলিশ

‘মশা’ গল্পে যেমন এক জাপানি বিজ্ঞানী সৃষ্টি করেছিলেন একটি বিষাক্ত লালারস-সম্পন্ন মশা, যা কিনা পৃথিবী জুড়ে মানবজাতির মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেবে। ‘পোকা’ গল্পে আবার জ্যাকব রথস্টাইন পরিকল্পনা করেছিল, সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া নামক একটি পোকার মাধ্যমে সে সভ্য ইউরোপে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে দেবে। দুটি ক্ষেত্রেই দুই বিকৃত-মনষ্ক বিজ্ঞানী নিজেদের গবেষণাগার তৈরি করেছিল লোকচক্ষুর আড়ালে, গহন অরণ্যের মধ্যে। এবং এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে, দুই বিজ্ঞানীই তাদের ক্ষুরধার বিজ্ঞান-প্রতিভাকে এমন হীন উদ্দেশ্যে নিয়োগ করেছিল পরাজয়ের গ্লানি থেকে। ‘মশা’ গল্পে ঘনাদা যে দ্বীপটির কথা বলেন, সেই সাখালীন দ্বীপ একসময় রাশিয়ার অধীনে থাকলেও পরে জাপানিদের কুক্ষিগত হয়, বিশ্বযুদ্ধান্তে জাপান হেরে গেলে আবার তা রাশিয়া অধিকারে আসে। এই সাখালীনেই ওই জাপানি বিজ্ঞানী প্রাণঘাতী গবেষণায় লিপ্ত হয়। আর জ্যাকবের এই কাজের পিছনে ছিল প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ইহুদি হওয়ার দরুন প্রতি ক্ষেত্রে অপমান হজম করার আগুন।

আরও পড়ুন
হাসপাতালের নাম হবে রাধাগোবিন্দ করের নামেই, লক্ষাধিক টাকার প্রস্তাব ফিরিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র

ঘনাদার একেকটি গল্প লিখতে গিয়ে প্রেমেন্দ্র যে পরিমাণ পড়াশোনা করতেন, তা ঘনাদার বিজ্ঞানের রহস্যটি বুঝিয়ে দেওয়ার সাবলীল ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রেমেন্দ্রর সমাজ-চেতনা, যে চেতনার অন্যতম ছিল ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা। লিখতে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে বলতে গিয়ে নিজেই বলেছিলেন – ‘সত্যিকার লেখা শুধু প্রাণের দায়েই লেখা যায় – জীবনের বিরাট বিপুল দায়।’ সেই কারণে ঘনাদার প্রথমদিকের বহু গল্পেই এসেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি। সেখানে ঘনাদার সাধারণ একজন মানুষ থেকে মানব-হিতকারীর পর্যায়ে যে উত্তরণ, তা প্রকৃত অর্থেই প্রেমেন্দ্র-র নিজস্ব চেতনার পরিচায়ক।

আরও পড়ুন
শান্তিনিকেতনে পড়াতে ডাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে-সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা লীলার

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বজোড়া বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে জৈবিক অস্ত্রের অস্তিত্ব নিয়ে উঠে আসছে একের পর এক তত্ত্ব, চলছে পরস্পরের প্রতি অবিরাম কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ি। প্রেমেন্দ্র মিত্রদের প্রজন্ম বহু আগেই গত, এই সময়ে একজন ঘনাদার ফিরে আসাও কঠিন। তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের চূড়ান্ত অসচেতনতা, অবৈজ্ঞানিক পন্থার অসহায়ত্ব চেপে ধরছে সমাজকে। বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে দিন-রাত এক করে অগণিত মানুষকে বাঁচানোর পরিসংখ্যান, বিপদ তুচ্ছ করা ডাক্তার-নার্সদের অসম লড়াই – চেতনা পুরোপুরি ফুরোয়নি, ফুরোবে না।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More