হত্যাকারীর মধ্যেই খ্রিস্টকে খুঁজেছিলেন দস্তয়েভস্কি

‘কেননা সকলেই পাপ করেছে এবং ঈশ্বরের গৌরববিহীন হয়েছে।’

                                         রোমীয়, ৩ – ২৩, নিউ টেস্টামেন্ট

উনিশ শতকের রুশ লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কি রাজদ্রোহের অপরাধে অর্ধেক যৌবন কাটিয়েছিলেন সাইবেরিয়ায়। দূর নির্বাসনে তাঁর সঙ্গী ছিল একটি বই, রুশ ভাষায় অনূদিত ‘নিউ টেস্টামেন্ট’। একটা বদ্ধ ঘরে তিরিশজন কয়েদি মিলে গাদাগাদি করে থাকার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল, সেই কথা তিনি লিখেওছেন ‘হাউজ অব দ্য ডেড’ বইতে।  নরকে ঝলসে আটত্রিশ বছরের ফিওদর ফিরে আসেন শহরে; বাকিটা জীবন ভুগেছেন মৃগী, রুগ্নতা ও বদমেজাজের অসুখে। নির্বাসনে যাওয়ার আগে দুটি-তিনটি উপন্যাস বেরোতে কিছুটা নাম হয়েছিল, ফিরে এসে আবার লেখা শুরু করেন। এই পর্যায়েই লেখা হয় বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘নোটস ফ্রম আণ্ডারগ্রাউন্ড’ (১৮৬৪) এবং ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ (১৮৬৬)। নায়কেরা ছিল অন্তেবাসী চরিত্র, তাদের ‘হিরো’ না ব’লে ‘অ্যান্টি-হিরো’ বলাই ঠিক হবে। শহর সেন্ট পিটার্সবুর্গ ছিল গল্পের পটভূমি।

আণ্ডারগ্রাউন্ডের চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিটি ‘ইঁদুরের গর্তে’ বসে সবকিছু নজরে রেখেছিল, মনুষ্য সভ্যতার রগড়গুলো এভাবেই চিনতে পেরেছিল এক এক ক’রে। কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিংবা পরিত্রাণের বাসনা থেকে নয়, স্রেফ নিজের অসোয়াস্তি কাটাতে সে কথা বলতে শুরু করে, কাদের উদ্দেশে সেটাও খুব স্পষ্ট ছিল না তার কাছে। নোট লিখবার খাতায় জমে উঠেছিল প্যাঁচানো ও কাঁপা-কাঁপা অক্ষর; দিনটা ছিল হাড় কাঁপানো, ঘরের জানলায় জমে ছিল কালচে হলুদ তুষার। ‘নাঃ, লিভারটা পচেই যাচ্ছে, বুঝলেন’... সে আক্ষেপ করে জানায়, যদিও ডাক্তার দেখানোর ইচ্ছে তার ছিল না। কী এক অজানা আক্রোশে সে নাগাড়ে বকবক ক’রে গিয়েছিল, অভিশাপ দিয়েছিল, চেঁচিয়েছিল। ‘মশাই, আমার একটা কীট হওয়ার যোগ্যতাও নেই’, তার মুখে শুনি আমরা।

আরও পড়ুন
যদুভট্টের থেকে পালিয়ে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ, স্বীকার করেছেন নিজের গানের সীমাবদ্ধতাও

পরের শতকে মিথপ্রতিম চরিত্র গ্রেগর সামসা রাতারাতি বদলে যাবে একটি কুৎসিত পোকায়, গল্পের নাম ‘রূপান্তর’, লেখক ফ্রানৎস কাফকা ‘রক্তের আত্মীয়’ বলে ডাকবেন অগ্রজ দস্তয়েভস্কি-কে।...‘হ্যাঁ, দাঁতের ব্যথার মধ্যেও দেখবেন আনন্দ আছে’, গবেষণালব্ধ এই তথ্য আণ্ডারগ্রাউন্ড ম্যান আমাদের গর্বের সঙ্গে জানায়। বাঙালি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে ‘দাঁতের ব্যথায় ভুগছেন এক দার্শনিক’ কবিতায় এই উক্তিটির উল্লেখ রেখেছেন। ...সেন্ট পিটার্সবুর্গের এক তরুণী বেশ্যার সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব করেছিল দস্তয়েভস্কির চরিত্র, যে-সম্পর্কের গ্লানি তাকে কুরেকুরে খায়, নিজের নীচতা নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমাজের প্রহসন ও আত্মার সংকট নিয়ে আলবিয়ার কাম্যু লিখেছিলেন ‘দ্য ফল’, যেখানে চরিত্র ক্লামাসের কাছেও এমনই এক উন্মোচন (revelation) হয়েছিল, ‘ফল’-এর ন্যারেশন-শৈলী ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’কে প্রায় হুবহু অনুসরণ করেছে। ...সজাগ, অকর্মণ্য, গর্তজীবী, বিদ্রোহী রুশ কন্ঠস্বরকে এড়িয়ে যাওয়া বিশ শতকের পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল না দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
‘বেঞ্চের ওপর ঐ ছাতাটি রয়েছে’ – তক্ষুনি লিখে দিলেন বিনয়; হারিয়ে গেছে সেই কবিতাও

তবে জীবন কি ন্যক্কারজনক, তবে কি বেঁচে থাকারই অযোগ্য... কেননা মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ অবধি শুধুই অন্তহীন আগুন জ্বলেছে! ...এলোমেলো ভাবে লেখা নোটখাতাটি হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়, বেঁচে-থাকা ও সভ্যতার বিপক্ষে সব রকমের যুক্তি সাজিয়ে সহসা কথা বলা বন্ধ করে দেয় লোকটি, ...‘মনে হল লেখাটা এখানে শেষ করলেই চলে।’ ভূতল থেকে তারপর আর কিচ্ছুটি শোনা যায় নি।  

আরও পড়ুন
বিশ শতকের সবচেয়ে ‘বুদ্ধিমান’ ব্যক্তিত্ব বলা হয়েছিল তাঁকে

নিজেকে ‘মনস্তাত্ত্বিক লেখক’ বলতে চাননি ফিওদর, বরং বলেছিলেন, ‘বিশেষ ধরণের বাস্তববাদী’। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসটি বাস্তবের এত বেশি কাছে রয়েছে যে তা প্রায় দুঃস্বপ্ন তুল্য হয়ে ওঠে। লেখক নিজের গল্পের সমস্ত চরিত্রকে যেন চাক্ষুস দেখেছেন - তাদের চেহারা, পোশাক আশাক, মুদ্রাদোষ, অভিব্যক্তি, কথা-বলবার ঢং, সবটাই! সেন্ট পিটার্সবুর্গের রাস্তা, ভাঁটিখানা, নোংরা বস্তি, বেশ্যাপটি, খেটে খাওয়া মজদুর, গরিব বেশ্যা, দুঃস্থ ছাত্র, মাতাল কেরানি, সুদখোর বুড়ি, লোভী পাহারাওলা – এই সমস্ত কিছুই দেখতে দেখতে হেঁটেছিল প্রটাগনিস্ট রাসকলনিকভ, তার মাথার মধ্যেই যেন রাখা ছিল লেখকের কলমটা! তার পর্যবেক্ষণ, ইন্দ্রিয়ে দাগ কেটে যাওয়া শব্দ-ছবি-স্পর্শ-গন্ধ, সেই নিয়ে বিশ্লেষণ চলেছিল নিরন্তর। সিনেমার ভাষায় বললে লেখক একটা ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ শট যেন নিয়ে গেছেন এবং সেই সিনেমা অশরীরী নয়, তার একটি রক্তমাংসের প্রত্যক্ষ শরীর আছে। দর্শক-শ্রোতা ও পাঠক হিসেবে আমরা সেই ‘শরীর’টির সঙ্গে একাকার হয়ে যাই।
 

আরও পড়ুন
তর্কের জবাব দিতেন না ‘বৌঠাকরুন’, কাদম্বরীর কাছে রবীন্দ্রনাথের হার ছিল অবশ্যম্ভাবী

আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান সভ্যতার সংকটগুলো শনাক্ত ক’রে দেখিয়েছিল, বোঝা গেছিল যে ‘নিহত উজ্জ্বল ঈশ্বর’ আমাদের জ্যান্ত জিজ্ঞাসার জবাব দিতে পারবেন না। এই উপন্যাসে ফিওদর সেই জবাব খুঁজতে চাইলেন এবং সর্বত্র প্রশ্ন করলেন - ইতিহাসের কাছে, পুরাণের কাছে, রাজনীতির কাছে, বিশ্বাসের কাছে! তবে কি মানুষ... মানুষের কাছেই রয়েছে উত্তর? তাঁর চরিত্রেরা সকলেই দুর্দশায় ডুবে আছে, প্রায়শ্চিত্তের আগুনে পুড়েছে, তাদের অসংলগ্ন কথাও এত প্রাজ্ঞ লাগে আমাদের! মাতাল মার্মালেদভ রাসকলনিকভকে বলছে, ‘বুঝলেন মশাই, দারিদ্র্য আর দৈন্য এই দুটো আলাদা! দারিদ্র্য কোনো পাপ নয় মশাই, কিন্তু দৈন্য একটা পাপ!’ – রাসকলনিকভ সুদখোর বুড়িকে খুন করার কথা ভেবেই বিড়বিড় করে বলেছে, ‘এ আমি কী করতে যাচ্ছি! ...কিছু না, নিজের কল্পনা উশকে একটু মজা করা, স্রেফ ছেলেমানুষি!’ বেশ্যা, বান্ধবী, সরলমতি সোনিয়ার সামনে উত্তেজিত হয়ে সে কখনো বলেছে, ‘আমি চেয়েছিলাম নিচু হয়ে সামনে থেকে জিনিসটা কুড়িয়ে নিতে পারি কিনা দেখতে, নিজেকে কিনারায় নিয়ে যেতে’... কখনো অস্বীকার ক’রে উঠেছে, ‘না! খুনের দায় আমার না, সেই শয়তানের... সে-ই আমাকে দিয়ে এটা করিয়েছে!’

পাগলাটে খুনির যন্ত্রণা আর ক্রুশবিদ্ধ যিশুর যন্ত্রণা যেন এক হয়ে গেছে!  খুনি আর বেশ্যা – রাসকলনিকভ আর সোনিয়া দুজনে স্বল্প আলোয় বাইবেল পড়েছে - মৃতদের মধ্যে থেকে ল্যাজারাসের উঠে আসার বিবরণ! লেখকের আর্ত প্রশ্ন, এই পাপী আত্মারা কি আলো পেতে পারে? আছে কি কোনো অপ্রত্যাশিত উৎস, যার করুণায় সহ্যের-অতীত এই বাস্তব শুদ্ধ, সহনীয়, উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে? পূর্বজ মনীষী ভলত্যের যেমন বলেছিলেন, ‘ভগবান না থাকলেও আমাদের উচিত একজন ভগবানকে নির্মাণ করা’... দস্তয়েভস্কি বুঝতে চেয়েছেন, ন্যায়ের অর্থ কী, এই বাস্তব কি চোরাবালি না পাথুরে মেঝে... আর্তনাদ করেছেন, ‘তবে কীসের অপেক্ষা করে আছি আমরা!’

আধুনিক যুগে খ্রিস্ট উত্থিত হবেন না, মৃতদের মধ্যে থেকে কেউ এসে আমাদের জানাবে না তা সত্যিই সম্ভব হয়েছিল কিনা। পিটার্সবুর্গ শহরের আণ্ডারগ্রাউন্ড ম্যান, রাসকলনিকভ, সোনিয়া, মার্মালেদভ, সভিদ্রিগায়লভ – সকলেই নিজের নিজের ক্ষত কামড়ে ধ’রে থেকেছে, আমাদের দিকে চেয়ে তাদের পলক পড়েনি।  ...‘আমেন’, লক্ষ বছরের বৃদ্ধ সভ্যতার পোড়ো জমিতে দাঁড়িয়ে দস্তয়েভস্কি স্বস্তিবাচন করেন, যার সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে একটি সুইডিশ সিনেমার সংলাপ, 

...‘বাবা, দোহাই, আমাকে একটা প্রমাণ দাও ঈশ্বরের, নাহলে আমি বাঁচব কী ক’রে!’ 

‘বাছা, আমি জানি না প্রেমের অস্তিত্ত্বই কি ঈশ্বরের প্রমাণ, অথবা প্রেম নিজেই ঈশ্বর কিনা!’

(উদ্ধৃতিঋণ - ইঙ্গমার বার্গম্যান, ‘থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি’)

Powered by Froala Editor