ট্রিগার থেকে শাটারে – এক রঙিন মানুষের বেরঙিন মৃত্যু

বাইজু কে বাসুদেবন, কেরালার অন্যতম কুখ্যাত শিকারি ও অবৈধ মদ প্রস্ততকারক হিসাবে তাঁকে দূর দূর অব্দি এক নামে চিনতেন সবাই। বুনো শুয়োর ও হরিণ শিকারের জন্য যাঁর আশ্রয়ই হয়ে উঠেছিল আথিরাপিল্লি ও তৎসংলগ্ন ভাজহাচাল-এর জঙ্গল। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠাও আথিরাপিল্লিতেই। দশ বছর বয়স থেকে হাতের উল্টোপিঠের মতো এই জঙ্গলকে মুখস্থ করে ফেলেন তিনি। স্কুল জীবন শেষ হতে না হতেই স্থানীয় একটি শিকারিচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বাইজু। এদের কাজ, বুনো শুয়োর ও হরিণ শিকার।

এভাবে কেটে যায় বেশ কিছু বছর। ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার হয়ে আথিরাপিল্লির দায়িত্বে আসেন ইন্দুচুরান। ১৯৮৮ সাল। এখান থেকেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় বাইজুর। নম্র, দরদী ইন্দুচুরান ধীরে ধীরে বাইজুকে বোঝাতে সক্ষম হন প্রকৃতি ও জীবজন্তু সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। হাতে ধরে তাকে শেখান ছবি তোলা। গাইড করে দেন সমস্ত কিছুতে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কুখ্যাত শিকারি হয়ে ওঠেন জঙ্গলের রক্ষাকর্তা। ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার হিসাবেও কেরালায় যথেষ্ট নাম করেন বাইজু। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বহু সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তিনি। তবে হাজার হাজার কেরলিয়ান যুবক যুবতীর কাছে বাইজু অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে ওঠেন একটি ঘটনার দ্বারা। একটি অসহায় ফিমেল হর্নবিল ও তার বাচ্চাগুলিকে নিজে হাতে খাইয়ে আগলে বাঁচান বাইজু, মেল হর্নবিলটির মৃত্যুর পর। জঙ্গলপথে দ্রুত চলা একটি গাড়িতে চাপা পড়ে গতবছর মারা যায় পুরুষ পাখিটি। এরপরই একটি ভিডিওতে দেখা যায় এক বিরাট গাছে চড়ে রোজ তাদের বাসায় খাবার রেখে আসেন বাইজু। বাচ্চাগুলির শারীরিক অবস্থারও খেয়াল রাখেন। কেবল হর্নবিল নয়, আরও প্রায় ২৪টি ডিসট্রেসড প্রাণীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি গতবছর। একটি হরিণকে বাঁচান যার পেট থেকে প্রায় ৫ কেজি প্লাস্টিক উদ্ধার হয়। ভিডিওটি ভাইরাল হয় এবং একজন পশুহত্যাকারী থেকে মানবিকতার উদাহরণ হয়ে ওঠা বাইজু নায়ক হয়ে ওঠেন গোটা সমাজের কাছে।

সময়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অস্ত্র ছেড়ে ক্যামেরা ধরেছিলেন মানুষটি, সম্প্রতি একটি সংস্থা তৈরি করেছিলেন নিজের এলাকায় ট্রাইবাল স্কুল তৈরির জন্য। আথিরাপিল্লি ঘুরতে যাওয়া পর্যটকেরা প্রায় সকলেই একবার দেখা করে আসতেন তাঁর সঙ্গে। তবু ভাগ্যে কিছু অন্য লেখা ছিল, নিজের বাড়ির ছাদে জল ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যান তিনি। গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় তাঁকে ১৫ই জুন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে হতে ১৬ তারিখ মধ্যরাতে মারা যান তিনি। প্রকৃতি আগলাবার দুটি হাত কমে যায় পৃথিবীর বুকে। আজ ওয়ার্ল্ড ফোটোগ্রাফি ডে-তে তাই এমন এক আলোকচিত্রীর কথা না জানালে অন্যায় হয়। ভালো থাকুন বাইজু, যেখানেই থাকুন, সবুজ করে রাখুন চারিদিক…

চিত্র ঋণ - ফেসবুক