‘পাঁঠার বাংলা’ খেতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ, গিলে নিতেন কাঁচা ডিমও!

বাঙালি হিসেবে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে রবীন্দ্রনাথ। তাই আজকের দিনে রবি ঠাকুরের খাওয়াদাওয়া নিয়ে আলোচনা হবে না, তা হয় নাকি! 

‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ ফলারের এক অন্যরকম বর্ণনা দিয়েছেন৷ ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,/ সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে-/ হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ,/ পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে৷’ ছড়া লেখার সূচনালগ্নে বোধহয় নিজের খাওয়ার কোনও অভিজ্ঞতাই এইভাবে ছড়ার ছন্দে প্রকাশ করেছিলেন কবি৷  ঠাকুরবাড়ির লোকেরা যথার্থ ভোজনরসিক ছিলেন। নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হতেন না। ঠাকুরবাড়িতে পাকা আম ভাতে, পাকা পটলের টক, কাঁচা ও কচি তেঁতুলের ঝোল, বেগুন ও কাঁচাকুলের টক, তিল বাটা দিয়ে কচি আমড়ার অম্বল রান্না হত। রবি ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী পাকা আমের মিঠাই বানাতেন। শেষপাতে দই ও সন্দেশ অপরিহার্য ছিল। মিষ্টির নানারকম নামও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একবার একটি মিষ্টি খেয়ে নাম দেন ‘এলোঝেলো’, পরে বদলে রাখেন ‘পরিবন্ধ’। রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জানো সবরকম কলার মতো রন্ধনকলাতেও আমার নৈপুণ্য ছিল। একদা মোড়া নিয়ে রান্নাঘরে বসতাম এবং স্ত্রীকে নানাবিধ রান্না শেখাতাম।’ এভাবেই তৈরি হয়েছিল মানকচুর জিলিপি। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় তিনি স্ত্রীকে মানকচুর জিলিপি তৈরি করতে বললেন। মৃণালিনী প্রথমে হেসে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু খেয়ে দেখা গেল সেটা জিলিপির চেয়ে ভালো হয়েছে। কবি বললেন, ‘দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন শিখিয়ে দিলুম।’ কবিপত্নী হেসে বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে পারবে কে? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।’

তাঁর সময় ঠাকুরবাড়িতে 'পাঁঠার বাংলা' নামক এক পদের উল্লেখ আছে। ১৯৪১ সালে, কবিগুরু মৃত্যুর ঠিক দুই বছর আগে কালিম্পং থেকে জোড়াসাঁকোতে আসেন ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর নিয়ে। এই বিশেষ পাঁঠার মাংস তাঁর খাদ্যতালিকায় ছিল। এই মেনু বাঙালির খাদ্যতালিকায় অবলুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, "Do not blame the food because you have no appetite." তাঁর খুব প্রিয় খাদ্যের মধ্যে ছিল কাবাব। তা ছাড়াও তিনি খুব পছন্দ করতেন আনারস দিয়ে তৈরি রোস্টেড পাঁঠার মাংস। নানান রান্নার ক্ষেত্রেই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঠাকুরবাড়ির হেঁশেল ঘটিয়েছিল। পূর্ণিমা ঠাকুর ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইতে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। 

১৯১৩ সালে কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগের বছর ১৯১২ সালে লন্ডনে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওই দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্যতালিকা হয়েছিল কবির পছন্দে। এই খাবারের তালিকায় ছিল : গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস অ্যান্ড কিউকামবার, প্রি সলটেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম। বাইরে এই ধরনের খাবার খেলেও বাড়িতে তিনি কম তেল-মশলাযুক্ত খাবার খেতেন। কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তাঁর হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন। 

আরও পড়ুন
স্বদেশি যুগ, ‘কপিরাইটার’ রবীন্দ্রনাথ ও যাদবপুরের সুলেখা মোড়

স্বাস্থ্যসচেতন কবি নিজের খাদ্যাভাস নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। একবার এক বিদেশি বন্ধু এসে বললেন, ডিম হচ্ছে আসল খাদ্য। ওতে সব রকমের গুণ আছে। এরপর কী হল? রানী চন্দ লিখেছেন, ‘গুরুদেব কাঁচা ডিম ভেঙে পেয়ালায় ঢালেন, একটু নুন-গোলমরিচ দেন, দিয়ে চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলেন। রাতের খাবার, দিনের খাবার এই একভাবে চলে।’ একবার এক আয়ুর্বেদজ্ঞ বললেন নিমপাতার রস সর্বরোগনাশক। ব্যস, শুরু হয়ে গেল নিমপাতার রস খাওয়া। রানী চন্দকে বললেন, ‘বেশি ডিম খাওয়া ভালো নয়। বেশি কেন, ডিম একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। বরং নিমপাতার রস খাবি রোজ কিছুটা করে।’ ঠাকুরবাড়িতে প্রায়শই খামখেয়ালি সভা বসত। সেই সভায় কবি থাকতেন মধ্যমণি। সেই খামখেয়ালিপনা থেকেই হয়তো তিনি রাত দুটোর সময় মৃণালিনী দেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন। শোনা যায় এই ঘটনা প্রায়শই ঘটত আর মাঝরাতে মৃণালিনী দেবী রান্না করে রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াতেন। কবি দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। এ ছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব নোসি। এখানেই শেষ নয়, কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। তাঁর নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালনী তাঁকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও ঠাকুরবাড়িতে রক্ষিত আছে। ঠাকুরবাড়ির রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হত। রান্নার তালিকায় প্রতিদিনই দীর্ঘ পদ থাকত। আর তাতে নিয়মিত অবশ্যই থাকত শুক্তো আর দইমাছ। 

আরও পড়ুন
স্বাদে-সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল; ঐতিহ্যবাহী গয়না বড়ি এবার আপনার নাগালেও

ঠাকুরবাড়ির আর এক রত্ন অবনীন্দ্রনাথ যে লাইব্রেরি থেকে রান্নার বই বার করে রীতিমত রান্নার ক্লাস খুলেছিলেন, সে কথাও তাঁর দৌহিত্র মোহনলাল লিখে গেছেন। অবন ঠাকুরের রাঁধুনি রাধুকে নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা চলত। প্রচলিত প্রথাকে বদলে দেওয়া হত। পেঁয়াজ প্রথমে ভাজার হলে তাকে শেষে ভাজতেন। শেষে সাঁতলাবার জিনিস প্রথমেই সাঁতলাতেন। যাকে ভাজতে হবে তাকে সিদ্ধ করতেন। এই প্রথাতেই তিনি ‘মুরগির মাছের ঝোল’ আর ‘মাছের মাংসের কারি’ আবিষ্কার করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কয়েকটি রান্না আবিষ্কার করেছিলেন। সে রান্নার কথা একটি খাতায় লেখা হয়ে তাঁর বড়ো মেয়ের কাছে ছিল। বড়ো মেয়ে মারা যাওয়ায় সে খাতাও হারিয়ে যায় চিরকালের মতো।

আরও পড়ুন
সরস্বতী পুজো ঘিরে বিতর্কে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ, চাকরি খোয়ালেন জীবনানন্দ

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী নিজে রান্না না করলেও রন্ধন বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ভালো কিছু খেলেই তাঁর রেসিপি লিখে রাখতেন লাল একটা খাতায়। পরে পূর্ণিমা ঠাকুর সেই খাতাটি উপহার পেলে, খাতার রেসিপি আর তাঁর মা নলিনী দেবীর রেসিপি মিলিয়ে ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ নামে দারুণ একটা বই লেখেন। এখানে স্যালাড, চাটনি আর মিষ্টি তৈরির নানা অভিনব পদ্ধতির কথা বলা আছে। রেণুকা দেবী চৌধুরানীও ‘রকমারি আমিষ রান্না’ ও  ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’ নামে দুটি উচ্চমানের কুকবুক লিখেছেন, যা আজও গৃহিণীদের একান্ত উপযোগী। এই বইতে চাং পাঁঠা রান্নার কথা আছে। মায়ের দুধ ছাড়িয়েই তাঁকে মাচার উপর বেঁধে প্রচুর ছোলা ঘাস ইত্যাদি দেওয়া হয়। নড়াচড়া না করার জন্য তাঁর মাংসের আঁশ শক্ত হয় না। খাবার উপযুক্ত হলে তাঁকে মাচা থেকে নামিয়ে খাওয়া হয়। ঊনষাট রকম ভাজা কিংবা দইভাত খাইয়ে হাঁসকে রন্ধন উপযোগী করে তোলার কথা রেণুকা দেবীই প্রথম বলেন।

রবি ঠাকুরের খাওয়ার এক বিচিত্র অভ্যাস ছিল। তাঁকে দিতে হত সব পদ। তিনি ঢাকা খুলে খুলে এক একটা পদ দেখতেন আর পুত্রবধুকে নির্দেশ দিতেন “এটা ওঁদের বাড়ি দিয়ে আস। ওঁরা ভালবাসে”, “এটা তাঁদের”, এমনি। আর নিজে খেতেন খুবই অল্প।  তিনি যখন সকালের জলখাবারে বসতেন তখন পাখিদেরও ভোজ অনুষ্ঠিত হত। কবিকে দেখলেই পাখিরা তাঁর পাশে আনাগোনা শুরু করত। আর কবি মুঠি মুঠি ছড়িয়ে দিতেন মুড়ি। শালিক, চড়াই, পায়রার পাশাপাশি কাকও জুটত। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, “কাকগুলোকে আমার দেখতে ভালো লাগে না, তবু মনে ভাবি দেখতে যেমনই হোক, ও বেচারাদেরও তো কিছু দাবি আছে এই ভোজের সভায়, তাই আর তাড়া দিতে ইচ্ছে করে না।” শান্তিনিকেতনে এক কুকুরকে গায়ের রঙ মিলিয়ে কবি নাম দিয়েছিলেন ‘লালু’। কবির খাওয়ার সময় লালু কাছাকাছি এসে রাস্তার দিকে মুখ করে শান্ত হয়ে বসে থাকত। রবীন্দ্রনাথ যখন তার নাম ধরে ডাকতেন তখনই ঘুরে তাকাত। কবি পুরু করে মাখন মাখিয়ে পাউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দিতেন। লালু চুপচাপ খেয়ে চলে যেত। কবি বলতেন, “দেখেছো? কত সভ্য কুকুর আমার। ওর কোনোরকম হ্যাংলামি নেই। …একেই বলে আসল আভিজাত্য। সেইজন্যেই তো আমি ওকে এত ভালোবাসি।”

রবি ঠাকুরের খাওয়াদাওয়া নিয়ে এক মজার গল্প দিয়ে শেষ করি। একবার চিন ভ্রমণকালে রবি ঠাকুর সহ শান্তিনিকেতনী অতিথিদের নাকি চিনারা এই ডিম দিয়ে বরণ করেছিল। বেশ গাঢ় নীল ডিমগুলো খেয়ে নন্দলাল বসু কোনোক্রমে টিকে গেলেও ক্ষিতিমোহন সেন মশাইয়ের সারারাত বারেবারে বমি বাহ্যে অবস্থা খারাপ। সবারই প্রায় সেই দশা। ব্যতিক্রম একমাত্র গুরুদেব স্বয়ং। তিনি বেশ কটি ডিম খেয়েও স্থির। সবাই অবাক। পরে জানা গেল গুরুদেব নাকি প্রায় ম্যাজিকের কায়দায় ডিমগুলোকে মুখে না ঢুকিয়ে দাড়ির আড়ালে বুকে পাতা ন্যাপকিনের তলা দিয়ে শিল্পীসুলভ কৌশলে সরাসরি জোব্বার পকেটে চালান করেছিলেন। সাধে কি বলে গুরুদেব!

Powered by Froala Editor