পরীক্ষা আসছে, পরীক্ষা যাচ্ছে; ‘শিক্ষিত’ হচ্ছি কি?

অবশেষে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, গতকাল প্রকাশিত হল মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। এবং এই বছরেও মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বেরোনোর পরে দেখা গেল সেই একই ছবি— পাসের হারে নতুন রেকর্ড এবং সাফল্যের হারে জেলার জয়জয়কার। জয়জয়কার বললেও ভুল, বরং বলা যায় একপেশে আধিপত্য। মেধাতালিকার প্রথম দশে থাকা ৮৪ জন ছাত্র-ছাত্রীই কলকাতার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে!

যদিও বছরের পর বছর এই বাড়তে থাকা পাশের হার এবং প্রশ্নপত্র থেকে পরীক্ষা পদ্ধতি, সবটাই কেমন যেন একটু হলেও ধোঁয়াশা মেশানো। প্রতিবছরই একটা ‘কমন ট্রেন্ড’ দেখা যায় মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর। মাধ্যমিকে যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জেলার ছাত্র-ছাত্রীদের জয়জয়কার থাকে, সেখানে উচ্চমাধ্যমিকে দাপট দেখায় কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা। কাউকে বিন্দুমাত্র ছোট না করেও মনের মধ্যে একটা কাঁটা যেন খচখচ করতেই থাকে, যে ছাত্রছাত্রীরা মাধ্যমিকে এত ভালো ফলাফল করছে, পরবর্তীকালে উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে জেলার ছাত্র-ছাত্রীদের সেই রকম সাফল্য কেন সেইভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না? তাছাড়াও প্রতিবছর এই বিপুল হারে এবং বিপুল পার্সেন্টেজ নিয়ে পরীক্ষার খাতায় নাম্বার তুলে পাস করে গেলেও আদতে কতটা শিখছে ছাত্রছাত্রীরা, ঠিক কতটা শিক্ষিত হতে পারছে তারা, সেই নিয়ে একটা সন্দেহের জায়গা থেকেই যায়।

সন্দেহের জায়গাটা এখানেই থাকে যে, পরীক্ষায় নাম্বারের ভূমিকা গুরুত্বের কথা কম করে দেখার কথা একদমই বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে কী উপায়ে বা আসলেই বিষয় সম্বন্ধে কতটা জ্ঞান লাভ করে পরীক্ষায় বসছে ছাত্রছাত্রীরা। শুধুই কি ‘কমন’ পাওয়ার উদ্দেশ্যে চলছে পড়াশোনা? আদতেই তাদের জিজ্ঞাসু মনের বিকাশ ঘটছে কি? নাকি শুধুই ধরাবাঁধা কিছু পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থেকে মুখস্থ বিদ্যার সাহায্যে একটা সামাজিক উচ্চতায় উঠতে চাওয়ার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই পরীক্ষার ফলাফল?

এক্ষেত্রে অস্বীকার করা যায় না বাবা-মায়েদের ভূমিকা। তারা কি একবারও ছাত্র-ছাত্রীদের কে বুঝতে শেখাচ্ছেন যে, আসলে সারা জীবন ধরে যত পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে, এই একটা মাধ্যমিক পরীক্ষা তার কাছে অতি নগন্য ধুলিকণা মাত্র? তারা কি একবারও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে গিয়ে তাদেরকে শেখাচ্ছেন শুধু পড়া নয়, বরং জানাটাই আসল কথা? কখনো কি তৈরি করে রাখছেন ভবিষ্যতের আরও বড়ো, আরো কঠিন পরীক্ষার অচেনা-অজানা প্রশ্নপত্রগুলোর জন্য?

গবেষণা বলছে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দিন দিন বেড়েই চলেছে অ্যাংজাইটি কিংবা ডিপ্রেশনের মতো রোগ। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার খবর অথবা অকথ্য চাপ সামলাতে না পেরে আত্মহননের মতো সংবাদ অহরহ ভেসে উঠছে সংবাদমাধ্যমে। মনোবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই ‘স্যাডিস্ট’ মানসিকতা আসলে গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তাই মাধ্যমিক আসবে, মাধ্যমিক যাবে। কিন্তু জীবন পাঠের কতটা শেখা হবে, সেই নিয়ে একটা বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

এক্ষেত্রে কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এই যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের বিকাশ ঘটছে, এটা কি সবসময়েই খারাপ? তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, এই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের ফলেই হয়তো আরো ভাল ফলাফল করার জন্য অথবা আরো বেশি পরিশ্রম করার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। অথচ তাঁরা কি একবারও জানতে চেয়েছেন, এই প্রতিযোগিতার ঘেরাটোপে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিনা কিশোর-কিশোরীদের সরল, স্বাভাবিক, সহজ মন? রেজাল্ট বেরোনোর পরেরদিনেই সকালে সংবাদপত্র খুলে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় স্থানাধিকারীর ইন্টারভিউগুলোর পাশেই কোথাও মুখ গুঁজে আরো একটা খবর থাকবে না তো, যেখানে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেউ, লেখা থাকবে এরকম? 

আরও পড়ুন
প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের জন্য ‘পৃথিবীর পাঠশালা’, শিক্ষার নতুন দিগন্ত চেনাচ্ছেন শহরের তরুণরা

আশঙ্কা জাগে। আশঙ্কা জাগে তার কারণ হল, প্রকৃত শিক্ষা আসলেই এভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কারণ হতে পারে না। শুধুমাত্র পরীক্ষায় নাম্বার তোলার জন্যই যদি আমরা ফাঁকা মাঠে দাঁড়ানোর সময় না পাই, আকাশের দিকে, গাছের দিকে তাকানোর সময় না পাই, যদি এভাবেই নীল-সবুজ রঙেরা হারিয়ে যেতে থাকে আমাদের শিশুদের জীবন থেকে, তাহলে বলতে অসুবিধা নেই সেই শিক্ষাকে অস্বীকার করার সময় হয়ে এসেছে হয়তো!

আমাদের সন্দেহ জাগে আজকে চিরাচরিত বিষয়গুলির বাইরে গিয়ে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে কতটা ধারণা দেওয়া হয় আমাদের ছাত্রছাত্রীদের। খেলাধুলা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, এখনকার দিনের টেকস্যাভি স্মার্টফোন প্রজন্মের থেকে এগুলো দূরে সরিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। বরং ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’র দৌলতে অবাস্তব তথ্য পেয়ে যেন তাদের মানসিকতা শুরুতেই খারাপ না হয়ে যায়, তার জন্য বিদ্যালয় স্তর থেকেই প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করার অত্যন্ত প্রয়োজন বোধ হয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে।

তাই ছাত্রছাত্রীদের সামনে বই খুলে না দিয়ে, বরং তাদের বাইরে থেকে অনুপ্রাণিত করা প্রয়োজন বোধ হয়, যে আদতে শিক্ষালাভের প্রয়োজন কেন এবং ঠিক কোন জায়গাটায় গিয়ে শিক্ষার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে হয় আমাদের। সেই অনুপ্রেরণাটুকু পেলেই আমাদের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই প্রয়োজনীয় বই বা পড়ার আশ্রয়টুকু খুঁজে নেবে ঠিক, অথবা জিজ্ঞেস করবে— এই ভরসাটুকু বোধ হয় তাদের উপর রাখতেই পারি আমরা। কিন্তু তার বদলে শুধুই যদি স্কুল-বাড়ি আর প্রাইভেট টিউশনে তাদের বন্দি করে ফেলে খুড়োর কলের মতো মাধ্যমিকের র্যা ঙ্ক তাদের চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ঠিক কতটা শিক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমরা পরবর্তীতে পেতে চলেছি, সেই নিয়ে এখন থেকেই আমাদের যথেষ্ট সাবধান হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন
শিক্ষাক্ষেত্রে আবার সাফল্য, বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুকুটে কিউএস আইগজ ই-লিড পুরস্কার

আরও একটা সাধারণ বিষয় এক্ষেত্রে মনে ধাক্কা দেয়। বরাবরই ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েদের শুনতে হয় যে, পড়াশোনা না করলে রিকশা চালাতে হবে কিংবা ঝাড়ুদার হতে হবে। অর্থাৎ প্রথমেই হয়তো অবচেতনভাবেই একটি বিশেষ পেশার প্রতি ঘেন্না বা নীচ মনোভাব আমাদের ছেলেমেয়েদের মনে তৈরি করে দিচ্ছি আমরা নিজেরাই। এরসঙ্গেই প্রাসঙ্গিক, ঠিক কতটা ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে তুলতে পারছি আমরা তাদেরকে। পরীক্ষায় ‘তোমার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য’ বা ‘জীবনে কী হতে চাও’ এই জাতীয় রচনা এলে গড়পড়তা সবাই কি এখনও লিখে আসছে শিক্ষক, ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন?

ডাক্তারি, শিক্ষকতা অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং অবশ্যই মহৎ পেশাগুলির মধ্যে অন্যতম; কিন্তু চারপাশে আরও এত হাজার-হাজার লোক তো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যাঁদের কেউ ডাক্তার নয়। শিক্ষক কিংবা ইঞ্জিনিয়ারও নয়। হয়তো সাংবাদিক; হয়তো সরকারি কর্মচারী কিংবা দশটা-পাঁচটার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বেসরকারি সংস্থার কর্মচারী। এরাও যে বেঁচে আছেন, এভাবেও যে বেঁচে থেকে বেঁচে থাকার পরীক্ষা দিয়ে যাওয়া যায়, এই আদর্শ বেঁচে থাকার শিক্ষাটা তাদের মনে ঢুকিয়ে দিতে না পারলে, শুধু মাধ্যমিকের রেজাল্ট সম্বল করে কতটা এগনো যাবে, সেই ব্যাপারে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করার সময় ভীষণ ভাবেই এসেছে।

বুকে হাত রেখে বলুন তো, আমাদের ছেলে বা মেয়ের থেকে কম নাম্বার পেলেও পাশের বাড়ির যে ছেলেটা গাছ লাগায় বাড়িতে, কল থেকে জল পড়ে নষ্ট দেখলে বন্ধ করে দেয় কিংবা ফুটবল মাঠে গোলের সামনে থেকেও পাস বাড়িয়ে দেয় বন্ধুকে— সে আসলেই কি সত্যিই পিছিয়ে রইল ওইটুকু নাম্বারের তুলনায়?

আরও পড়ুন
কেন্দ্রের তালিকায় প্রথম দশে যাদবপুর, কলকাতা; স্থান পেল রাজ্যের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More