‘আজ থেকে আমি প্রাক্তন’; বিস্তীর্ণ মহাকাব্যের একটা হলুদ পাতা উল্টে গেল এভাবেই

একটা ছোট্ট পোস্ট। ‘আজ থেকে আমি প্রাক্তন’। সময় বলছে সন্ধে ৭ টা বেজে ২৯ মিনিট। সময় আরও অনেক কিছুই হয়তো বলতে চাইছে কিন্তু একটা আশ্চর্য ভারী হয়ে আসা কুয়াশার গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে সেই কথা। সুশান্ত সিং রাজপুত চলে যাবার ঠিক ২ মাস পর, ১৫-ই অগাস্ট, ২০২০ সাল, কোনো প্রেসমিট না, কোনো বুলেটিন না, কোনো জাঁকজমক না, স্রেফ একটা পোস্ট!

ওয়াংখেড়ের সেই রাতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা শান্ত দুটো চোখ। গ্ল্যামার আর জৌলুসে মোড়া ভারতীয় ক্রিকেটে মাহি সেই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যান যাঁকে পরোয়া করতে হয়নি কোনো কিছুর৷  আপনি ঐ দুহাতে এসে ধরা দিয়েছে সৌভাগ্যকুণ্ডলী, এক প্রাচীন প্রবাদ - Fortune favours the brave, আর যে লোকটা উইকেটের পিছন থেকে যোগিন্দার শর্মার দিকে বল ছুঁড়ে দেন বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ ওভারে তার বিদায়গাথার আগমনীতে ব্রেভারি থাকবে, গ্ল্যামার না, ক্রিকেটের আইন, জীবনেরও!

একটু বেশি রাত হলে চারপাশে মানুষের ভিড় কমে আসে, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে গেলে ক্রমশ গাঢ় হয় সিস্টোল-ডায়াস্টোলের শব্দ,মাটিতে পা দিলে বুঝতে পারি পৃথিবী প্রহর গুনছে, সময়ের চাকা ঘুরে চলেছে কোনো আদিম মন্ত্রের বশে।

চোখ বন্ধ করলে এখনো একটা প্যানোরামার মতো ভেসে ওঠে ছবিগুলো, একটু নিচে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, প্রেস-মিডিয়ার ধাক্কাধাক্কি, তিনি এলেন। নিজের টেস্ট শার্টটা গা থেকে খুলে শেষবারের মতো খুলে ছুঁড়ে দিলেন নীচে- ভারতীয় ক্রিকেটে শেষ হল 'দাদাতন্ত্র', চেনা অহংকার, চেনা আগ্রাসন সবকিছু বাইশ গজে রেখে হারিয়ে গেলেন মহারাজ, ক্রুশকাঁটায় রক্তাক্ত শরীর থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত ফোঁটা কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন ভারতের বুকে নীরবে বেড়ে চলা একটা ছেলে, তিনি কাছ থেকে দেখছিলেন সবকিছু, চুপ করে একটু একটু করে শিখেছেন লড়াই-এর বানান...

টুইটারে নিন্দার ঝড়, ফেসবুকে একের পর এক কটূক্তি, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা নিয়ে মাঠে নামলেন সেদিনের সেই ছেলেটা, লম্বা চুলগুলো আর নেই, চেনা ডানপিটে মনটা বদলে গেছে শান্ত প্রজ্ঞায়। মাঠে নেমে চোখ বুজলেন, পায়ের তলায় কম্পন অনুভব করতে পারেন তিনি, বহুকাল, তিনি জানেন এই মাটি যেমন যুধিষ্ঠিরের রথের চাকাকে হাওয়ায় ভাসায় তেমনি গেঁথে দেয় কর্ণের রথ - এই মাটি তাঁর দেশের ,তাঁর মায়ের - এর ঘ্রাণে এখনো রক্ত গরম হয়ে ওঠে তাঁর...

কপিল দেব-আজহারউদ্দিন-সৌরভ-এর বৃত্তচাপের শেষবিন্দু থেকে যেদিন লড়াইটা শুরু করলেন মাহি, তিনি জানতেন এই ভারতীয় ক্রিকেট আসলে এক কুরুক্ষেত্র, এখানে তাঁকে হতে হবে কৃষ্ণ, তিনি ঘুরে তাকালেন না, তাঁর চোখে রইল এই বৃত্তচাপের অন্যবিন্দুখানা, তাঁর ক্রিকেটবিধাতার কাছে পণ রইল এই বৃত্তটাকে শেষ করার।

আরও পড়ুন
ধোনির সঙ্গে একই পথে হাঁটলেন সুরেশ রায়না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বাঁহাতির

সৌরভীয় স্পর্ধা থেকে মাহি সাম্রাজ্যের দৃঢ় বিনয়। ২০০৭ ভারতীয় ক্রিকেটের টালমাটাল চ্যাপেল জমানা থেকে সচিন তেন্ডুলকরের একটা সাজেশন৷ মাস্টারব্লাস্টার হয়ত বুঝেছিলেন সৌরভের কঠিন বাঁধনকে ফের একবার শক্ত হাতে বাঁধতে পারেন এই লম্বা চুলের ছেলেটাই। বেপরোয়া বাইকপ্রেমী, ছয় মারতে ভালবাসা ইয়ুথ সেনসেশন মাহির কাঁধে ভারতীয় ক্রিকেটের ভারী ব্যাটন তাকে বানাল ক্যাপ্টেন কুল। দায়িত্ববোধ জন্ম দিল এক স্থিতধী মস্তিষ্কের, ঐশ্বরিক অনুমান আর বরফের মতো শীতল মস্তিষ্ক ভারতীয় ক্রিকেটের মুকুটে জুড়তে শুরু করল একটার পর একটা পালক। 

সফলতম? জিজ্ঞাসার চিহ্ন তুলে প্রশ্নাতীতভাবে দাঁড়ি বসানোই যায়। ভারতের একমদ্বিতীয়ম মাহি, যার ক্যাবিনেটে ঢুকেছে আই সিসির সমস্ত ফরম্যাটে দেশকে চ্যাম্পয়ন করার বিরল কৃতিত্ব। সাফল্যের বিচারে অজি ওয়াঘ-পন্টিং দের টেক্কা দিচ্ছে এক ভারতীয়! 

অবিশ্বাস্য! 

আরও পড়ুন
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, স্বাধীনতা দিবসের দিনেই এল ঘোষণা

ক্রিজ-এ স্টান্স নিয়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে যোগিন্দর শর্মার কথা, মনে পড়ে সেদিনের সেই শ্রীসান্থকে প্লেস করার ডিসিশনটা, মনে পড়ে ভারতের হাত থেকে ফসকে যাওয়া একটার পর একটা সুতো চক্রের মতো নিজের আঙুলে টেনে নিয়েছেন তিনি, তাঁর সিংহাসনে বেড়েছে আভরণ, তাঁর মুকুটে জুড়েছে পালক, তাঁর মাঠে হেঁটে বেড়ানো হয়েছে প্রতিপক্ষের কাছে মাসাইমারার জঙ্গলে সিংহের নিঃশ্বাসের মতো...

বোলার ক্রমশ এগিয়ে আসছে, মাহি দূর থেকে শুনতে পাচ্ছেন বিদায়ঘণ্টা, ক্রিকেট ঈশ্বর যেন দুহাত মেলে তাঁকে ডাকছেন, সেদিনের সেই ছেলেটা যাকে একদিন সৌরভ জেদ করে নিয়ে এসেছিল দলে সে-ই ছোট্ট চারাগাছ এতগুলো বছর ভারতীয় ক্রিকেটকে দিল বনস্পতির ছায়া, বোলারের চোখে চোখ রাখলেন ভারতভাগ্যবিধাতা, বুকের তেরঙা পতাকাটা যেন খামচে ধরছে শরীর, এই নীল জার্সি অতীত হতে চাইছে না চেনা শরীরটা ছেড়ে, বলটা ড্রপ খেয়ে এগোলো মাহির দিকে - মাহি চোখ বুজে ব্যাট তুললেন - বন্ধ চোখের ভেতর খেলা করছে ২০১১ বিশ্বকাপ, ২০০৭ বিশ্বকাপ, ভারতের ১ নম্বর র্যা ঙ্কিং, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়কের তকমা...

যেভাবে স্টাম্প ছিটকে দিতেন উইকেটের পিছনে এতকাল সেভাবেই চোখ মেললেন, শেষবার ব্যাটের মাঝখানে লাগল বলটা, চেনা শব্দ - আকাশের দিকে তাকালেন মাহি, বলটা একটু একটু করে আলো জ্বেলে দিচ্ছে অন্ধকার আকাশটাতে, সেখান থেকে স্পষ্ঠ হচ্ছে অবয়বগুলো, সৌরভ-সচিন-তাঁর প্রাণের বন্ধু যুবি-বীরু-জাহির আরও কত সহযোদ্ধা হাত নেড়ে ডাকছে তাকে, মাহির চোখের কোনে জল, সময়ের দুর্লঙ্ঘ্য সুতোয় দুলছে সাদা বলটা, চারদিক থেকে গাঢ় হচ্ছে চিৎকার-

আরও পড়ুন
না চাইলেও থামতে হয় – অবসরে সেটাই বুঝিয়ে দিলে, প্রিয় ক্যাসিয়াস

" ধো নি ধো নি ধো নি..."

তিনি চোখ বুজলেন, অসমাপ্ত ক্রিকেট বৃত্তের দুটো বিন্দু মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি, তাঁর বুজের পাঁজর থেকে জন্ম নিয়েছে বিরাট-রোহিত-ভুবি-বুমরা-রাহুল-পান্ডিয়ারা, নিজের সমস্ত শক্তি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইশতেহার করে বিলিয়ে দিয়ে মাহি একটু একটু করে চলে যাচ্ছেন ক্রিকেটের সোনালি ইতিহাসের দিকে, বয়ে চলেছে ভারতীয় ক্রিকেট, সে বিস্তীর্ণ মহাকাব্যের একটা হলুদ পাতা উল্টে গেল আজ, আমাদের কৈশোরের সিলেবাসের শেষ অধ্যায় ...

Powered by Froala Editor