পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন!

অকৃত্রিম প্রকৃতির সঙ্গে বেহিসেবি মানব সভ্যতার অনিবার্য সংঘাতে পৃথিবীর চিরহরিৎ প্রান্তর আজ জরাজীর্ণতায় বিবর্ণ। কোনো একদিন, কোনো এক কালের অন্তে, সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই চুলচেরা হিসেবনিকেশ মেলাতে বসবেন। মানুষ বিজ্ঞানকে সাধের পৃথিবীটা মানুষ সহ সকল প্রাণীর বাসযোগ্য করে তোলার তাগিদে অধিক ব্যবহার করেছে, নাকি পৃথিবীময় প্রকৃতিজাত প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার আকুতিকে ভেঙে খান খান করার নেশায় মানুষ বিজ্ঞানকে অধিকতর হাতিয়ার করেছে? মানব সভ্যতা কৃত বিজ্ঞানের আবির্ভাবই কিন্তু প্রকৃতি বিরুদ্ধ সকল ক্রিয়াকলাপ উন্মোচনের তাগিদ থেকেই। যেমন ধরা যাক, এখন প্রখর গ্রীষ্ম এবং সেটাই বর্তমান প্রকৃতি। কিন্তু বিজ্ঞান প্রকৃতি বিরুদ্ধ হয়েই বৈদ্যুতিন পাখা এবং বাতানুকূল যন্ত্রের আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রকৃতির সেই বিরূপ প্রকোপ থেকে মানব জাতিকে স্বাচ্ছন্দ্যের পথ দেখিয়েছে। অথবা ধরা যাক এখন কনকনে শীতের প্রকোপ, যা কিনা বর্তমান প্রকৃতিরই স্বরূপ। সেক্ষেত্রেও বিজ্ঞান প্রকৃতি বিরুদ্ধ হয়ে শীতবস্ত্র এবং তাপানুকূল যন্ত্রের আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রকৃতির সেই বিরূপ প্রকোপ থেকে মানব স্বাচ্ছন্দ্যের পথ চিনিয়েছে। এমন ভুরিভুরি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, বিজ্ঞানের উদ্ভব বিরূপ প্রকৃতিকে সামাল দেওয়ার তাগিদ থেকেই, যা কিনা মানব জাতির টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও নিঃসন্দেহে তা প্রকৃতি বিরুদ্ধ।

মানব জাতির হিতকল্পে বিজ্ঞানের অবদান নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মনুষ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত অকৃত্রিম প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের কাজে মানুষ বিজ্ঞানেরই শরণাপন্ন হয়েছে। যেমন, মনুষ্য দ্বারা অরণ্য ধ্বংস রোধ ও পুনরুদ্ধারের কাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগ। কিংবা মনুষ্য দ্বারা জীব হত্যা রোধ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যবহার। সুতরাং, প্রকৃতির সাথে মানবজাতির দৈনন্দিন সংঘাতের প্রশ্নে বিজ্ঞানকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না; বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগের যত দায় প্রযুক্ত বিজ্ঞানের চাবিকাঠি আগলে বসে থাকা মানুষেরই। আরও নিখুঁত ভাবে বললে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান ক্ষমতা কেন্দ্রিক কতিপয় মানুষ... যাদের বাক্য বোঝাই জীব সেবার চিৎকৃত প্রতিশ্রুতি, অথচ গোপন আস্তিন বোঝাই রক্তলোলুপতার অন্তহীন আয়োজন।    

আমরা এই পৃথিবীর বুক চিরে কী না করিনি! অথচ চেয়েও দেখিনি পৃথিবীর বুক ভরে কতটা রক্ত জমাট বাঁধল! আদিগন্ত আকাশের কান ছুঁয়ে আমরা রকেট ছুটিয়েছি, চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে আমরা হৃদয় খুঁড়ে এনেছি, বায়ু তরঙ্গকে উথালপাতাল করে আমরা বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় মেতেছি। সেই সঙ্গে আপাত শান্তির খড়কুটোময় নীড়ে বোঝাই করে ফেলেছি ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান, উদ্যত মিসাইল, গনগনে আগুনের সীসা সমৃদ্ধ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। ঝাঁক ঝাঁক মৃত্যু দানব প্রহর গুনছে মৃত্যুদূতের পলকের ইশারার অপেক্ষায়। আলতো একটি বোতাম টেপার সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের গোটা পৃথিবীর অস্তিত্ব। এক মুহূর্তের ইশারা ধ্বংস করে দিতে পারে রাশি রাশি রঙ-রস-রূপে সমৃদ্ধ নির্মল প্রকৃতিকে, কয়েক হাজার বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা মানব সুসভ্যতাকে। পৃথিবীর এক প্রান্ত জুড়ে শিকড় ছেঁড়া গুল্মলতার মতো লুটিয়ে পড়বে কাতারে কাতারে নিথর ঝলসানো লাশ। আর অপর প্রান্ত জুড়ে চলবে নিখুঁত মৃত্যু উদযাপনের বাঁধভাঙা উল্লাস। 

সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ যদি থেকে থাকেন, চেয়েছিলেন নাকি এই পৃথিবী! একথা নিশ্চিতভাবে সত্য, সৃষ্টিকর্তা এই পৃথিবী নামক উপগ্রহটাকে সৃষ্টি করেছেন বিপুল অসাম্যে ভরে। নইলে একই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়েও কারো বেঁচে থাকার মেয়াদ একশো বছর, আবার কারো ক্ষেত্রে মোটে কয়েক ঘণ্টাই বা হবে কেন! কেউ জন্ম নিচ্ছে বৈভবশালী দেশের বিত্তবানের কোল আলো করে, আবার কারও জন্ম হচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে! এ অসাম্য নয়? সৃষ্টিকর্তা যদি পৃথিবীটা বিপুল অসাম্যে জর্জরিত না করতেন, অসাম্য দূরীকরণের দুর্নিবার তাগিদে সন্তান-সংসার সব রসাতলে পাঠিয়ে দিনভর শুধু কাগজ ও কলমকে অবলম্বন করে মার্ক্স সাহেবের এত তত্ত্বকথা লেখার প্রয়োজনটাই আদৌ হত নাকি! কিন্তু পৃথিবী ব্যাপী এই অসাম্যের অস্তিত্ব যদি না থাকত, তবে জগৎসংসারের ভারসাম্যটাই কিন্তু বেসামাল যেত বৈকি। বাঘ আর হরিণকে সমান শক্তিধর করে পাঠালে খাদ্য-খাদকের অমোঘ জৈবিক ভারসাম্যটাই যে চুলোয় যেত! তাই প্রাকৃতিক অমোঘ নিয়মে অসাম্য থাক। এবং অনিবার্য ভাবে সাম্যের বানী বয়ে মার্ক্স সাহেবরাও জন্ম নিক অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর কোলে আলোর দিশা ফোটানোর অমোঘ তাগিদ থেকেই। 

আরও পড়ুন
যুদ্ধ, মহামারী, অভিবাসনে অশান্ত গোটা বিশ্ব; ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে মানব সভ্যতা?

আবার অন্য দিক থেকে দেখলে, সৃষ্টিকর্তার ঠোঁটে সাম্যের সুরও গুনগুন করেছে বৈকি। পৃথিবীর জীবজগতের সকলকেই কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার নিজস্ব জীবনচক্র সম্পূর্ণ করার সুযোগ দিয়েছেন। তা সে মশার মতো কীটের তিনদিনের আয়ু সীমার মধ্যেই হোক, বা কচ্ছপের মতো প্রাণীর দুশো বছরের আয়ু কালের অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যেই হোক। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই কিন্তু জন্ম থেকে মৃত্যুর মধ্যে অন্তর্বর্তী সময়কালে তার নিজস্ব জীবন চক্র সম্পন্ন করার সুযোগ পেয়েছে। হয়তো অনেককেই মাঝপথে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। তবু সাধারণভাবে জীবন চক্র সম্পন্ন করার সাম্যবাদী সুযোগ সকল প্রাণীকুলের জন্যেই প্রকৃতি প্রসারিত রেখেছে। সেই অর্থে সৃষ্টিকর্তা সাম্যবাদীও ছিলেন বটে। এই সাম্য-অসাম্যের যুগলবন্দির পৃথিবীতে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। ঠিক যে কারণে এই পৃথিবীকে নিটোল রাখার দায় মানুষের ওপরই নিশ্চিতভাবে বর্তায়।

আরও পড়ুন
গত ৩ দশকে বদলেছে পৃথিবীর অক্ষরেখা, দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন

সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় প্রবল শক্তিধর সেই মানুষই যখন নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থে নিটোল প্রকৃতিকে টেনে হিঁচড়ে যথেচ্ছাচারে মেতে ওঠে, বিরোধের মাত্রাটা তখনই সীমাহীন হয়ে ওঠে। আর এই সহিষ্ণুতার বেড়াজাল টপকালেই প্রকৃতিকে অস্থির করে তোলে। সেই মুহূর্তেই বোধহয় প্রকৃতির রোষানল আছড়ে পড়ে পৃথিবীরই ওপরে। ঠিক তখনই মনে হয়, মানুষের এই অপার শক্তির কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? যে শক্তির বলে, বিত্ত অন্বেষণের নেশায় মানুষ অবলীলায় মানুষেরই নৃশংস হত্যালীলায় মগ্ন হয়ে পড়ে। যে শক্তির বলে, ক্ষমতা গ্রাসের উন্মাদনায় ধর্মীয় বিভাজন, জাতিগত বিভাজন, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অছিলায় অনায়াসে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধেই ক্ষেপিয়ে তুলে কতিপয় মানুষ লভ্যাংশ ঘরে তোলে। যে শক্তির বলে, স্বার্থ সিদ্ধির লোভে নিঃস্ব, নিস্পাপ মানুষকে পিঁপড়ের মতো টিপে মেরে ফেলা যায় নিছক খেয়ালেই। নাহ, সৃষ্টিকর্তাও এমন চাননি নিশ্চয়। মানুষের কি আদৌ কোনো দায় আছে সৃষ্টিকর্তাকে জবাবদিহি করার! তাই বুঝি মানুষই এমনটি পারে!               

আরও পড়ুন
চেঙ্গিস খান নন, জলবায়ু পরিবর্তনই মধ্যযুগীয় শহর ওত্রারের ঘাতক : সাম্প্রতিক গবেষণা

অবশেষে একটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ আণুবীক্ষণিক প্রোটিন পিণ্ডের কাছে আজ অবনত গোটা পৃথিবী। অবনত সেই অপার শক্তিধরেরাও, যারা দিনভর ফন্দি আঁটত তাঁদের বিপুল শক্তি ও অগাধ বিত্তের বশে সমগ্র পৃথিবীকে অবনত করার। শক্তির জোরে, বিত্তের দম্ভে গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করতে চেয়েছে যারা, প্রকৃতিই বোধহয় তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে বারেবারে রুখে দিয়েছে তাঁদেরই সেই সর্বগ্রাসী আগ্রাসন। 

এই পৃথিবীর দেওয়ালের পরে আজও জ্বলজ্বল করছে মার্কিন বোমার ছোবলে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা ফ্রক পরা সেই ছোট্ট নিষ্পাপ ভিয়েতনামি মেয়েটির প্রাণে বাঁচার তাগিদে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসার জ্বলন্ত ছবিটা। অথবা জ্বলন্ত সিরিয়ার মাটিতে শুয়ে বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ঝলসে যাওয়া সেই ছোট্ট শিশুটি নিশ্চিত মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তে যে হৃদয়বিদারক শব্দবন্ধগুলি আধো আধো উচ্চারণে সোচ্চারে বলে গিয়েছিল ... “ঈশ্বরকে আমি সব বলে দেবো।” যে শব্দবন্ধগুলির প্রগার দীপ্তি খবরের কাগজের পাতায় জ্বলজ্বল করে উঠলেও, শক্তির দম্ভে বলীয়ান সেই মানুষগুলির মনের অন্দরকে কি এতটুকুও আলোড়িত করতে পেরেছিল! এত হানাহানি, এত হিংস্রতা, এত পৈশাচিকতা পার হয়েও কি তাঁরা একটি বারের জন্যেও থামতে শিখেছে! প্রকৃতির কাছে করজোড়ে অকপট ক্ষমা প্রার্থনারও নিদারুণ প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন কখনও! মার্ক্সবাদী ইতালীয় দার্শনিক আন্তেনিও গ্রামসি রকেট সায়েন্সে সমৃদ্ধ এই পৃথিবীর কানে কানে দীর্ঘ এক শতক ধরে বিড়বিড় করে বলেই চলেছেন ... “The old world is dying and the new world struggles to be born; now is the time of monsters”।        

সিরিয়ার সেই ছোট্ট শিশুটির কথা ঈশর শুনতে পেয়েছেন কিনা জানা নেই। তবু তো সে এইটুকু বলে পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। শিশুটির এই আপাত নিরীহ কথাটি যেন প্রকৃতির গর্ভগৃহ থেকে উঠে আসা অকপট বজ্রনির্ঘোষ। যে কথা বলার ছিল মহা শক্তিধর দেশ পরিচালকদের। যে কথা বলার ছিল বিশ্ব পরিচালনার দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের। তবু তাঁরা বলেননি। হয়তো কোনদিন বলবেনও না। এমন নিস্পাপ নির্ভেজাল শব্দবন্ধ শক্তির বলে বলীয়ানদের মুখে আদৌ মানায় নাকি! ধানসিঁড়ি নদীর আলাপে বেড়ে ওঠা কবি বহুদিন আগেই পলে পলে অনুভব করেছিলেন... “পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; মানুষ তবুও ঋণী এই পৃথিবীর কাছেই”।            

(লেখক বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজের বাণিজ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সিমলার ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস)-এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট)

Powered by Froala Editor