‘হতে পারেন মহানায়ক, কিন্তু আপনি কিছুই দেখেননি!’

জনশ্রুতি বলে, মহানায়ক উত্তম কুমারের সামনে এসে থমকে গিয়েছিল তাঁর ধরহীন ক্ষতবিক্ষত মুণ্ডুটা। ১৯৭১ সালের ৫ই আগস্টের কাকভোর। কলকাতা ময়দানে প্রাতঃভ্রমণে গিয়েছিলেন মহানায়ক। তখন সে এক অস্থির সময়। নকশাল আন্দোলনের উদ্দাম ঝাঁঝে উত্তাল তিলোত্তমা। রেড রোড দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে আসা একটা কালো রঙের গাড়ি অতর্কিতে থেমেছিল মহানায়কের পথ রোধ করে। গাড়ি থেকে নেমে কতিপয় ষণ্ডামার্কা লোক রীতিমতো শাসানির সুরে তাঁকে সতর্ক করে বলেছিলেন, “উত্তমদা, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।” আতঙ্ক ও উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে মহানায়কের। শ্রাবণী ভোরেও তিনি ঘেমে একশা। তারপর থেকে আর কখনও ময়দান চত্বরে প্রাতঃভ্রমণে যাননি তিনি।

পুলিশের খাতায় বা সরকারি নথিতে সেই ধরহীন কাটা মুণ্ডুর মানুষটা আজও নিখোঁজ! ঘটনার ৫০ বছর পরেও! এই পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে একটি তথাকথিত বামপন্থী সরকার ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আসীন ছিল। এর পরেও আরও দশ বছর কেটে গেছে। অথচ তাঁর অন্তর্ধান বা হত্যা রহস্য উন্মোচনের তাগিদে কোনো সরকারই এযাবৎকাল পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিশন বসায়নি। ফলে তিনি মৃত, নাকি জীবিত... সে সম্বন্ধে কোনো কিছুই অদ্যাবধি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত নয়। তাই এই সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে সরকারি জাবেদায় তিনি শুধুই ‘নিখোঁজ’! তবু বৃষ্টিস্নাত ময়দানের আড়মোড়া ভাঙা ঘাসেদের ফিসফিসানিতে গুঢ় সত্যটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। এমনই এক শ্রাবণের কাকভোরে তাঁর কবন্ধ রক্তমাখা লাশ ময়দানের ঘাসে লুটিয়ে থাকার পর পত্রপাঠ তা লোপাট করার ব্যবস্থা করা হয়। হয়তো তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী, নির্ভীক কণ্ঠস্বর ও বৈপ্লবিক মনন শাসকদের অস্তিত্ব বড় বিপন্ন করে তুলেছিল। তাই কবি, প্রাবন্ধিক এবং সাংবাদিক শ্রী সরোজ দত্ত এমনি ভাবেই এতগুলো বছর ধরে ‘নিখোঁজ’ হয়েই সরকারি মহাফেজখানার আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকেন।

বন্ধুবর অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকাকালীন ১৯৭১ সালের ৪ই আগস্টের শেষ রাতে পুলিশ এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁকে আর কোথাও কেউ দেখেনি। সেই থেকেই তিনি আজও পর্যন্ত ‘নিখোঁজ’! সরোজ দত্তের অন্তর্ধানের স্বল্পকাল পরেই রাগে, ক্রোধে, ঘৃণায় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলম থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল সেই রক্তমাখা শব্দমালা... “যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে / সেই সব কালের জল্লাদ, তোমাকে পশুর মতো বধ করে আহ্লাদিত? নাকি স্বদেশের নিরাপত্তা চায় কবির হৃৎপিণ্ড?” সরকারি মহাফেজখানায় যাই লেখা থাক না কেন, সমাজের বিদ্বজন থেকে আমজনতার মনন পর্যন্ত সেই জনশ্রুতিই কিন্তু সত্য হিসেবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তরে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মেধাবী ছাত্র সরোজ দত্ত, যিনি তাঁর প্রারম্ভিক জীবন থেকেই ‘অগ্রণী’ ও ‘অরণি’ পত্রিকায় লাগাতারভাবে কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ লিখে এসেছেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু অমৃতবাজার পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে। কর্মী ধর্মঘটে যোগ দিয়ে চাকরি খোয়ান। ১৯৪৮ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘পরিচয়’ ও ‘স্বাধীনতা’-র সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে ‘পরিচয়’ সম্পাদনার দায়িত্ব তাঁকেই দেয়া হয় এবং ‘স্বাধীনতা’র সম্পাদক মণ্ডলীতেও তাঁকে যুক্ত করা হয়। ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের সময় চিন-দরদী সন্দেহে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জেলে থাকাকালীনই ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ ১৪ মাসের কারাগার পর্ব থেকে মুক্ত হয়ে তিনি সদ্য গঠিত সি পি আই(এম) দলে যোগদান করেন এবং সেই সঙ্গে দলের পত্রিকা ‘দেশহিতৈষী’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকাতেই ‘শশাঙ্ক’ ছদ্মনামে তাঁর একের পর এক আগুনঝরা লেখা প্রকাশিত হতে থাকে।

১৯৬৭ সালের ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’ বাংলার প্রান্তে-প্রত্যন্তে ছড়িয়ে পড়ার সন্ধিক্ষণে তিনি ভেসে যান বৈপ্লবিক আন্দোলনের উদ্দাম তোড়ে। ঘনিষ্ঠ হন অবিসংবাদী নকশাল নেতা চারু মজুমদারের সঙ্গে। ‘দেশহিতৈষী’র বদলে ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার দায়িত্বভার নিজহাতে তুলে নেন। এরপর থেকে শুরু হয় তাঁর সক্রিয় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড এবং ফলস্বরূপ, আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন। ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিয়মিত লেখনী ‘পত্রিকার দুনিয়ায়’ কলমে তিনি বৈপ্লবিক চিন্তাধারার উদ্দাম উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন আপামর বঙ্গ তারুণ্যকে। সেই কবে, ১৯৩৯ সালে, ‘কোনো বিপ্লবী কবির মর্মকথা’য় তিনি লিখেছিলেন ... ‘দুঃসাহসী বিন্দু আমি, বুকে বহি সিন্ধুর চেতনা’। সেই চেতনায় উদ্ভূত হয়ে নিজেকে এবং সমাজজীবনকে তোলপাড় করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর করে রেখেছিলেন। আমৃত্যু তিনি সেই দুঃসাহসী বিন্দুগুলো বুকের বাঁদিকের লাল টকটকে যন্ত্রে জড়ো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সমাজ বদলের উদ্দীপনায়। যে দুঃসাহসী চেতনা তাঁকে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী থেকে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীতে এবং পরিশেষে কমিউনিস্ট বিপ্লবীতে পরিবর্তিত করে ছিল। ক্ষোভের বিকিরণে ক্রোধ, বদলের আস্তিনে বদলা, নৃশংসতার মোকাবেলায় হিংস্রতা। একদল ভূমিহীন কৃষক। সঙ্গী সশস্ত্র বিপ্লবের আগুনে দীপ্ত এক ঝাঁক শিক্ষিত মধ্যবিত্তও। রাষ্ট্র ও তার শক্তি। এবং ‘খতম লাইন’।

সরোজ দত্তের অন্তর্ধানের পর ঠিক অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত। এই পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁর অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনের তাগিদ আমরা নাই বা অনুভব করলাম! কিন্তু আমরা কি কখনও বুঝতে চেয়েছি, বা পরবর্তী প্রজন্মেকে বোঝাতে চেয়েছি... কে ওই সরোজ দত্ত? নকশালবাড়ী আন্দোলনই বা আদতে কি ছিল? কেনই বা তা ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের’ মতো আছড়ে পড়েছিল? কোথায় ছিল তার আঁতুড়ঘরের নাড়ি? সরোজ দত্তরা কিই বা কেড়ে নিল এই সমাজজীবন থেকে? কতটুকুই বা দিয়ে গেলেন তাঁরা এই সমাজকে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা আজও সম্যকভাবে জানাতে পারিনি সেই রক্তক্ষয়ী ‘কালবেলা’র কতটাই বা সাদা, আর কতটাই বা কালো ছিল। সেই আন্দোলন কতটাই বা আমাদের পথ আটকালো, কতটাই বা পথ দেখালো। আমাদের ডিজিটাল হাতে সেইসব কাঁটাছেঁড়ায় যাওয়ার মতো কতটুকুই বা সময় আছে স্মার্ট ফোনের গোগ্রাসকে অগ্রাহ্য করে! ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন সাইটগুলোতে কতবারই বা আজ পর্যন্ত টাইপ করা হয়েছে ‘সরোজ দত্ত’ নামটা? অথবা ‘নকশালবাড়ি’ শব্দটা?

তাহলে, খতম লাইনের কুখ্যাত বীজটা কি সংগোপনে প্রোথিত হয়েই রইলো আমাদের সমাজজীবনের গর্ভগৃহে? নাকি আমাদের এই নাগরিক সমাজ মূল্য দিতে চাইল সেই সকল অদম্য প্রাণগুলোকে, যাদের মায়ের প্রেতাত্মা লাশের স্তূপের থেকে আজও খুঁজে চলেছে ‘হাজার চুরাশি’ নম্বর সাঁটানো তাঁর দামাল ছেলের দলা পাকানো লাশটা? সেদিনের সেই অস্থির সময় কি আমাদের দিয়ে গেল শুধুই খতম লাইনের দুঃস্বপ্নের ইতিহাস? শুধুই আবেগসর্বস্ব বজ্রমুষ্ঠির দিশাহীন আস্ফালনের ব্যর্থ প্রয়াসের ‘কালবেলা’? নাকি কোথাও আমরা শুনতে পেয়েছি অদম্য সাহসের কাঁধে হৃদয় গচ্ছিত রেখে উদ্দাম যৌবনের ‘হোক কলরব’-এর ঐকান্তিক কলতান? সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সমাজের পিছিয়ে পড়া শোষিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে। শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। সাম্যের সংগ্রামে। আজ আমাদের হাতে আদৌ ভাববার মতো সময় আছে নাকি? জীবনের মূল্যবোধ। রাজনীতির নীতিকথা। সমাজজীবনের সহমর্মিতা। নাকি সব খুইয়ে আজ আমরা একে একে সকলে এসে জড়ো হয়েছি আত্মকেন্দ্রিকতার আস্তাকুঁড়ে! তাই বুঝি এই রং ঝলসানো ডিজিটাল দুনিয়াতেও সরোজ দত্তরা ‘নিখোঁজ’ হয়েই উঁকি মারেন ইতিহাসের টিমটিমে আঁচের আস্তাবলের আড়াল থেকে!

(লেখক বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজের বাণিজ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সিমলার ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি-র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট। মতামত ব্যক্তিগত।)

Powered by Froala Editor