কেউ কিছু না বলেই হঠাৎ চলে গেলে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হুহু করে ওঠে। শৈশবের গৃহশিক্ষিকা দীপ্তি পিসি না জানিয়েই যে সন্ধে থেকে হঠাৎ আসা বন্ধ করে দিল। কৈশোরের কানামাছি ভোঁভোঁ খেলার গুঞ্জন ফেলে হঠাৎ যে ক্ষণে মৌ মৌচাকের সুখসন্ধানে অন্য কোন অরণ্যের পথে সপরিবারে পাড়ি জমাল। জ্যোৎস্না বোঝাই বাসা বাঁধার স্বপ্ন বুকে বেঁধে যৌবনের অনামিকা হঠাৎ যে বারবেলায় প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেল। সুজনদের জামরুল গাছে তিলতিল করে স্বপ্ননীড় বাঁধা দোয়েল পাখির সংসারটা হঠাৎ যে বৈশাখে নষ্টনীড় হয়ে চৌচির হয়ে গেল। প্রখর জ্যৈষ্ঠের নিদাঘ দুপুরে অপত্য স্নেহ জলাঞ্জলি দিয়ে হঠাৎ যেদিন শিশির পাতের নিঃসাড়ে মা দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে গেল। সব চলে যাওয়াতেই চুঁইয়ে পড়ে আজন্মের হাহুতাশ। করোনা ভাইরাসের দৌরাত্ম্য কালে কত অতি-পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত মানুষজনও তো কিচ্ছুটি না বলেই দুম করে হঠাৎ একদিন দূর আকাশে পাড়ি জমাল! ভয়ার্ত এই করোনা কালের বন্দীদশায় কাউকে নিয়ে এপিটাফ লিখতে বসিনি। মৃত্যু প্লাবনের শোকার্ত ঢেউয়ের শিখরে বসে অবিচুয়ারিই বা আর লিখব কত! তবু এই প্রখর গ্রীষ্মের নিদাঘ দুপুরগুলোতে জল-রোদ্দুরের কাটাকুটিতে কারা যেন আবছায়া হয়ে কেবলই ছায়াসঙ্গীর মতো ঘোরাফেরা করে হৃদি কুম্ভের চৌদিকে!
আরে, রঞ্জন না! সারি সারি কবরের নিচে মাথা গুঁজে কি খুঁজে চলেছিস তুই? মৃত্যুর অসাড় গন্ধ? নাকি কঙ্কালের আকুতির স্পর্শ? মনে পড়ে তোর? একদিন সকালে ঝাঁক ঝাঁক রোদ্দুরের বাহুতে ভর করে আমরা দুজন আচমকাই হারিয়ে গিয়েছিলাম দিগন্তের ডাকে! ভারতীয় রেলকে ফাঁকি দিয়েই। পথেই আলাপ, খাঁখাঁ রোদ্দুর গায়ে জড়িয়ে খিলখিল হাসিতে চলকে পড়া কত আকাশমণি, কাঠগোলাপ, কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে। চাক্ষুষ সীমানা দেখতে চেয়েছিলাম আমরা। “জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে” কিনা কে জানে! সেই প্রান্ত যতদূর অবধি আমাদের বাধাহীন বিচরণের অধিকার। যে প্রান্তরেখা পার হতে দ্বার প্রহরীদের কাছে জমা করতে হয় বিস্তর নথিপত্র। অথচ আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম, এই কৃত্রিম প্রান্তরেখা কিছুতেই আমাদের অবাধ বিচরণের অন্তিম প্রান্ত হতে পারে না। তবু রাষ্ট্রের কেটে দেওয়া দণ্ডির কাছে অবনত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ আমাদের কাছে উন্মুক্ত ছিল না। ঋত্বিকের সুবর্ণরেখার নায়কের মতো আমরাও মনে মনে নির্ঘাত বলেছিলাম, “ওইখানেই কোথাও আমাদের বাড়ি ছিল।” কিন্তু আজ তা আক্ষরিক অর্থেই পরদেশ। তুই সেদিনও প্রান্তরেখার মাটি খুঁড়ে কি যেন খুঁজেছিলি? নাকি শুঁকে দেখছিলি! পিতৃপুরুষের পদধূলির ছিটেফোঁটা ঘ্রাণও যদি পাওয়া যায়! তারপর পদ্মা, ইছামতী, মাথাভাঙার বুক চিরে রাশি রাশি ঘোলা জলের ধারা বয়ে গেছে। তুইও হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলেই মিলিয়ে গেলি মহাকালের গহ্বরে। অজর আমি আজও বয়ে নিয়ে চলেছি আমাদের শৈশব, আমাদের ছেলেবেলার রাশি রাশি ধুলোবালিগুলোকে। রঞ্জন, বলি বলি করেও তোকে একটা কথা আজও বলে ওঠা হয়নি। আমাদের দুর্ভেদ্য প্রান্তরেখা সত্যি সত্যি যেদিন ভেদ করে ফেলেছিলাম, সেদিন আমিও তোর মতোই মাটি খুঁড়ে খুঁজেছিলাম। কী জানিস? তোর আঙুলের গন্ধ। আকুতির কি আর প্রান্ত আছে রে! এপারে গচ্ছিত রাখা কৈশোরের আকুতির ধ্বংসাবশেষ যদি কিছু পাওয়া যায় প্রৌঢ়ত্ব বয়ে অন্য পাড়ে এসে!
আরে, আকাশ রঙা শাড়িটা আজ হঠাৎ উড়ে এল কোন কালান্তর পার হয়ে! গন্ধটা যেন কত জনমের চেনা! এত আলোকবর্ষ পরেও চিনে নিতে এতটুকুও তো ভুল হল না! তাঁর নাম ছিল রাকা। ইচ্ছে নদী বেয়ে চলা প্রথম যৌবনের রংচঙে নৌকার পালটা পতপত করে উড়েছিল ওর থইথই পূর্ণিমার আলোর আহ্ললাদেই। মাতলা তখনও হেজেমজে যায়নি। আমরা দুজন হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশের পথিক। নদীপথ ঠেলে, স্থলপথ ভেঙে আবার অন্য এক নদীর তোড়ে ভেসে পড়া। গন্তব্য নির্ধারিত নয়। তবু পথ চলতে চলতেই চলকে পড়া আনন্দের আস্বাদ। নিদাঘ দুপুর পার হয়ে বিকেলের পথে হঠাৎ দেখা আকাশ ভাঙা মেঘেদের সঙ্গে। দিগন্তের পৃথিবী জুড়ে যেন উল্লাসের উৎসব। দিকভ্রান্ত ঝড়ের মাঝে তবু স্বপ্ন বোঝাই টলোমলো নৌকার গলুই ছুঁয়ে প্রাণপণ। বন্ধ এক চিলতে দোকানের হেঁতাল পাতার ছাউনির নীচে আমরাই যেন আস্ত একটা পৃথিবী। মেঘের মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছে প্রবল সমুদ্র। অদৃশ্য আকাশ। ঝাপসা নদী পাড়। দুজনেই ভিজে একশা। তোর শরীর-মনে জড়িয়ে থাকা আকাশ রঙা শাড়িটাও। জলপ্রপাতের মতো ধেয়ে আসা বৃষ্টিকণার বালখিল্য লুটোপুটি। অধরে, চিবুকে কি প্রবল সমুদ্দুরের আকুতি। চোখের তারায় ধিকিধিকি আগুনের আঁচ। গলে পড়ার আগ পর্যন্ত স্ফটিকের মতো ঝুলন্ত জলবিন্দু তোর চোখের আগুনে পাতায়। করতল ভরে কাছিয়ে নিয়েছি বিন্দু বিন্দু জলের সবটুকু অভিলাষ। সময়ের ঢেউয়ের উদ্দামতা পার হতেই স্বপ্নিল পথ ধুলায় ঢেকে একাকার। হাহাকার ভরা নৌকার হৃদয়ে সময়ের পলিমাটির বেড়ি এসে জমাট। ক্লিষ্টতা বিছানো পথের শেষে এসে সহসা হাতের মুঠো খুলে ফেলি। করতলে লেগে থাকা সেই কবেকার জলবিন্দুগুলো বাষ্প হতে চেয়েও স্থবির হয়েই দাঁড়িয়েছিল। চমকে দেখি, হঠাৎ উড়ে আসা আকাশ রঙা শাড়িটার আনাচে কানাচে আজও কত ইচ্ছে নদীর সোহাগ চিহ্ন! জানিস, আমাদের সেই কুড়িয়ে পাওয়া বাবুই পাখির বাসাটা আজও থোকা থোকা জ্যোৎস্না ভরে রাখা আছে। হৃদ মাঝারে। ছেঁড়া ছেঁড়া পথ, ধুলো ওড়া মন... আলো আঁধারির মেলা। ছেড়ে যাওয়া হাত, বৃষ্টি হঠাৎ... আনমনে ছুঁয়ে ফেলা।
আত্মায় আশ্রিত মানুষজনগুলোর একে একে বুঝি বিলীন হওয়ার পালা। শূন্যতা অসহায়ভাবে আঁকড়ে ধরে সম্পর্কের শীর্ণ সুতোগুলোকে। স্মৃতিকাতরতায় বিদ্ধ হয় ঝরা পাতার হাহুতাশ দিয়ে ঢেকে রাখা রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড। জীবনানন্দ এসে স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে যান... “লীন হয়ে গেলে তারা তো মৃত। মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো, মৃতেরা কোথাও নেই, আছে? কোন কোন অঘ্রানের পথে পায়চারি শান্ত মানুষের হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই...”। সত্যি কি নেই! মৃতেরা কোথাও? অঘ্রানের আড়ামোরা ভেঙে শীত ভোরের কুয়াশা মাখা পোয়াতি ধানের শিষে কোথাও কি মিশে নেই তাঁরা? পরাবাস্তবের নিশুতি রাতের তোলপাড় করা বিছানার অশ্রুবিন্দুতে কোথাও কি লেগে নেই তাঁরা? শূন্যতা পার হতে সুবিশাল অরণ্য পেরোতে হয়। অরণ্যের গুল্মলতা বেয়ে জ্বর ওঠে। মন কেমনের পাতায় পাতায় কাঁপন ধরে। আগুয়ান জীবন দিগন্তের টানে ছুটে আসে। তবু দিগন্তকে কি সবাই ছুঁতে পারে!
আরও পড়ুন
নাচনি মা'র সারা শরীর থেকে ভেসে আসা সংলাপ
হিংস্র শ্বাপদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে মৃত্যু যেন হামলে পড়ছে জীবনের চরাচরে। পালিয়ে বাঁচার জো নেই। পিছনের দিন শ্বাসরুদ্ধকর নিকষ কালো ধোঁওয়ায় ঢাকা। সমুখের রাত্রি ঘোর অনিশ্চয়তার কাছে বাঁধা। ত্রস্ত জীবনে অবরোধের বেড়ি পায়ে পায়ে। শুকিয়ে যাওয়ার শঙ্কার মাঝেও ধাবমান জীবন তবু দিগন্তের টানে বয়ে চলে। নদীর মতোই। প্রতিটি নতুন ভোরে থোকা থোকা ফুল কুঁড়ির আগল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রতিটি নিঝুম দুপুরে পানকৌড়ি জল খুঁড়ে জীবন তুলে আনে। জোনাকির ঝাড় প্রতিটি সন্ধ্যায় উঠোনময় আকাশপ্রদীপ হয়ে জ্বলে ওঠে। আকাশ ভরা চন্দ্র তারা প্রতিটি রাতে পায়ে পায়ে এসে নিঃসঙ্গতার পলিতে জমাট বাঁধে। ব্যাধিগ্রস্ত আকাশতলে ঝলমলে আলো বিছিয়ে টকটকে কৃষ্ণচূড়া যেন কার অপেক্ষায় নিজেকে উজাড় করে রাখে। সচকিত কাঠবিড়ালির ল্যাজে জীবনের স্ফুলিঙ্গ যেন উছলে ওঠে। মড়ক লাগা পৃথিবী চিরে আজন্মের ধুলোবালি ঝাপসা চোখে আজও উড়ে আসে। গেরস্তের চাল বেয়ে হলুদরঙা কুমড়ো ফুল খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে। গোরস্থানে বেড়ে ওঠা গাছে গাছে ফুলের হাসি মিটিমিটি তারা হয়ে জ্বলে। জীবনের গন্ধে নড়েচড়ে ওঠে মৃতদের হৃৎপিণ্ড। অবহেলায় গজিয়ে ওঠা তিরতিরে চারাগাছ আলো করে কেঁপে কেঁপে ওঠে জীবনের অদম্য উচ্ছ্বাস। মৃত্যুকে জয় করে জীবনের স্পর্ধা গোরস্থান পার হয়ে এগিয়ে চলে বেঁচে থাকার অন্তহীন আকুতিকে বুকে বয়ে।
আরও পড়ুন
নতুন জীবনের, গলির আখ্যান
(লেখক বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজের বাণিজ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সিমলার ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি (আইআইএএস)-এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট)
আরও পড়ুন
যে লেখা লিখব বলে ভাবিনি কখনও
Powered by Froala Editor