‘দেশভাগ আলাদা করেনি, করল কাঁটাতার’; না-ভারত না-বাংলাদেশে দিন কাটে যাঁদের

প্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষ ও তার ৭৫ বছরের প্রবীণ স্বাধীনতা। এতদিনেও কিন্তু মুছে ফেলা যায়নি দেশভাগের আধেক-লীন স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন যন্ত্রণার চোরা রক্তস্রোত। অবিভক্ত বাংলার সীমানা বিভাজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আজও মিশে রয়েছে লক্ষ মানুষের বুকফাটা হাহাকার, লক্ষ ধারার কান্নার স্রোত, লক্ষ হৃদয় জুড়ে ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তক্ষরণের দগদগে দাগ। আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত ইতিহাসের সীমানা বেয়ে আজও চলকে পড়ে অনর্গল রক্তস্রোতের প্রবাহ! আর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছেন যারা, তাঁদের যন্ত্রণার ফল্গুধারা তিস্তা, পদ্মা, মাথাভাঙার স্রোতে ভাসতে ভাসতে মেঘনার স্রোতে মিশে সাগরের লোনা স্বাদে এখনও মুক্তি খুঁজে চলেছে। 

ভারত-বাংলাদেশের মোট ৪,০৯৭ কিমি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সীমারেখার মধ্যে সীমান্ত বরাবর প্রায় ৩,০০০ কিমি পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক আইনকে মাথায় রেখে ভারত প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমারেখা থেকে ন্যূনতম ১৫০ মিটার নিজ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে এই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে, সেহেতু কাঁটাতারের বেড়া এবং প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমানার (জিরো লাইন) মধ্যবর্তী অঞ্চলে দুর্ভাগ্যবশত যাঁদের বাসগৃহ পড়ে গেছে, তাঁরা কিন্তু ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে মধ্যে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধানে লোহার দরজা করা আছে, যা প্রয়োজনের তাগিদে নয়, শুধুমাত্র নিয়মের নির্দেশে খোলা ও বন্ধ হয়। সূর্যালোক থাকাকালীন কয়েক দফায় কয়েক ঘণ্টার জন্যে এই লৌহকপাট খুলে দেওয়া হয়। প্রহরারত বিএসএফ জওয়ানদের কাছে ভোটার কার্ড জমা রেখে এবং বিএসএফ-এর লগ বুকে নাম নথিভুক্ত করে কাঁটাতারের ওপারের ভারতীয় নাগরিকদের এপারের মূল ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশাধিকার। নিয়তির অদ্ভুত পরিহাসে কতিপয় খাঁটি দেশি সহনাগরিকদের নিজভূমে পদার্পণ করতেও প্রতিনিয়ত তথ্যপ্রমাণ দাখিল যেন পাসপোর্ট-ভিসারই বিকল্প অনুকৃতি! 

দেশ সুরক্ষার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দে দেশের সরকার কার্পণ্য না করলেও, অবহেলার পাহাড় যেন আকাশচুম্বী হয়ে আটকে রাখে এই হতভাগ্য সহনাগরিকদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত। যাঁরা আর্থিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী, তাঁরা নিতান্ত বাধ্য হয়েই কাঁটাতারের ওপারের ভিটেমাটি পরিত্যাগ করে এপারের মূল ভারত ভূখণ্ডে জমি কিনে নিশ্চিন্ত রাত্রিবাসের ঠাঁই বানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যারা একেবারেই কপর্দকশূন্য, তাঁদের প্রতিটি রাত্রি যাপনে ভিড় করে অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার ধিকিধিকি আগুনের আঁচ। সরকার গঠনের জন্য ফি বারের মতো এবারেও এঁরা ভোট দিয়েছেন। দেশ থেকেও নির্বাসিত এই দেশী মানুষগুলোকে পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকার পাইয়ে দেওয়া কি দেশের নির্বাচিত সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না! শুধুই প্রতীক্ষাকে সম্বল করে অহর্নিশি বেঁচে থাকেন তাঁরা... কোন এক ঝলমলে সকালে সকল অবহেলার গ্লানি মুছে ফেলে উঁকি মারবে নতুন দিনের গোলাপি সূর্য। কোন এক অদৃশ্যশক্তি এসে বিভাজনের সকল সীমানা উৎপাটিত করে মিলিয়ে দেবে পূর্ণ ভারতবর্ষকে। যে স্বভূমি স্পর্শ করতে তাঁদের আর কোন তথ্য-প্রমাণ নিত্যদিন হাজির করাতে হবে না। যে নিজভূমের সকল দুয়ার সর্বক্ষণ তাঁদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে থাকবে। ভাগ্যের করুণ পরিহাসে দেশের সীমান্তরক্ষার প্রাচীরের বাইরে নির্বাসিত এই স্বদেশি মানুষগুলোর কথা ভেবে কবে যে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেবে কোন সংবেদনশীল নির্বাচিত সরকার, কে জানে!  

লালমনিরহাটের সিরাজুল মিঞা কিংবা ভারতের মেখলিগঞ্জের নকুল বর্মণের ব্যাকুল হৃদয় থেকে করুণ আক্ষেপ আজও ছিটকে পড়ে বাংলার সীমান্তের বেড়াজালে। “দেশভাগ আমাদের আলাদা করতে পারে নাই, আন্তর্জাতিক সীমানা আমাদেরকে আলাদা করতে পারে নাই; কিন্তু এই কাঁটাতারের বেড়া আমাদের একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিল।” কাঁটাতার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনার বেশকিছু মেঠো জনপদ। চর মেঘনা, বিষ্ণুগঞ্জ... আরও কত নাম। মাথাভাঙ্গার আস্কারায় বেড়ে ওঠা নদীয়ার করিমপুর ১নং ব্লকের অধীনস্থ হোগলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এমনই এক ভারতীয় বসতি সম্পন্ন মেঠো জনপদ রয়েছে, যা কিনা কাঁটাতারের ওপারে অবস্থিত। কালচে বাঁশের বেড়ার ওপর শ্যাওলা ধরা টালির চালাগুলো যেন এই গাঁয়ের বাসিন্দাদের গার্হস্থ্য জীবনের নিবিড় প্রতিচ্ছবির নির্মম প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একপ্রান্তে তিরতির স্রোতে দুলতে থাকা সোহাগী মাথাভাঙ্গা। তারই ওপাড়ে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা। আর অন্যপ্রান্তে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে নিশিদিন প্রহরারত কাঁটাতারের বেড়া। ভূগোলের নির্মম পরিহাসে হলুদ ক্ষেতের প্রান্তে অনাদরে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়ার তিরতিরে পাপড়িও অস্ফুটে ডুকরে ওঠে। ঘোড়ানিম গাছ বেয়ে নেমে আসে হাহাকারের হাহুতাশ।     

মাথাভাঙ্গা নদী তার সর্পিল শরীর জড়িয়ে ঠিক আত্মজার মতো যে স্থলভূমিকে আগলে রেখেছে, সেই ‘অ-ভারতেই’ ওদের বাস। জেলা নদীয়া, দেশ ভারত। থুরি বাংলাদেশ। না, না – ভারতও নয়, বাংলাদেশও নয়। ওরা নামহীন, গোত্রহীন, স্বদেশবিহীন। তবে ভারত সরকারের দেওয়া ভোটার কার্ড আর রেশন কার্ড ওদের সকলের কাছেই আছে। এই কার্ডগুলোই যে ওদের কাঁটাতারের নিরাপত্তায় ঘেরা ‘নিরাপদ ভারত’ ছোঁয়ার ‘এন্ট্রি পাস’! ওদের ইহকাল, ওদের পরকাল! ওরা আদ্যোপান্ত ভারতীয়, তবু অভারতীয়! ওদের কাছে ভারত বলতে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত। তারপরেই ভূভারতের লৌহকপাট বন্ধ হওয়ার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। চারিদিকে ভারী বুটের কম্পিত আস্ফালন। চকচকে বেয়নেটের লকলকে জিহ্বার উঁকিঝুঁকি। মাঝেমধ্যে অ্যাসল্ট কালাশনিকভ থেকে বিদ্যুতের বেগে ছুটে যাওয়া আগুনের ঝলক। বক্ষছেদী বাংলার কর্ণ ভেদ করে মর্মভেদী তীব্র আওয়াজ। তারপর আবার সব শুনশান। মূল ভারতভূমির নিরাপত্তার খাতিরে পরদিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত বন্ধ থাকা লৌহকপাটের ওপারের নির্বাসিত ভারতে ওঁরা বন্দি হয়ে থাকে। আর ওই লৌহকপাট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর সব আলো ওঁদের জীবনে ফিকে হয়ে আসে। ওঁদের স্বাদ-আহ্লাদ, অসুখ-বিসুখ, হাহাকার-আর্তনাদ, সবই আটকে থাকে ওই লৌহ ফাটকের ওপারে। ওঁদের রাগ-অভিমান, দুঃখ-যন্ত্রণা, ভালোবাসা-মন্দবাসা পাক খেতে থাকে বাপ-ঠাকুরদার চরণধূলিতে লালিত কাঁটাতারের ওপারের বাস্তুভিটের গোবর নিকানো উঠোনময়। রাতগভীরে পোয়াতির তীব্র গর্ভযন্ত্রণা অথবা কারও হৃৎযন্ত্র বিকলের অসহ্য বেদনার তাগিদে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার প্রয়োজনেও লৌহকপাট খোলা যাবে কিনা তা নির্ভর করে প্রহরারত বিএসএফ জওয়ানদের দাক্ষিণ্যের ওপরে। আর সেই অসহায় আর্তনাদের উৎকণ্ঠায় শিউরে ওঠে ক্ষীণকায়া নদীর জলতরঙ্গ। থুরথুরে পেঁচার ডানায় ভর করে নদীতীরে রাত আরও নিশুতি হয়। বৃষ্টি ভেজা রাত্রি শেষের সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে ঘোড়ানিম গাছের মাথায় উঁকি মারে ঝলমলে শারদ সূর্য। 

অভাগাদের এই নির্বাসিত বাসভূমিতেও আশ্বিনের শারদ প্রাতে ঠিকরে ওঠে আন্দোলিত হৃদয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন কাকভোরে কানে ভেসে আসে “ওঁ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমঃ নমঃ”। অথচ এই অভারতের চরাচরে কোনো দুর্গাপূজাই হয় না। তবু উৎসবের হিল্লোলে দুলে ওঠে আদিগন্ত চরাচর। পথে, ঘাটে, প্রান্তরে, কাশফুলের সোহাগ জড়ানো নদীবাঁকে উড়ে বেড়ায় পুজোর আহ্ললাদি গন্ধ। ঘর-গেরস্থালীর নিকানো উঠোনময় খুশিতে উছলে ওঠে বল্গাহীন শৈশব, উদ্দাম কৈশোর। লাল ফিতের বাঁধুনিতে যৌবনের নিটোল খোপা বেয়ে দুলতে থাকে উত্তাল স্বপ্ন। ঘর গেরস্থালিময় পুজোর গন্ধ। শরতের ঝকঝকে সোনালি রোদের বাহুতে ভর করে দুলে ওঠে খুশির অষ্টপ্রহর। কিন্তু রাতে যে বেরোতে মানা! তাই দিনদুপুরেই সারা হয়ে যায় কাঁটাতারের এপারের ‘নিরাপদ ভারতের’ দুর্গা দর্শন। একরাশ বিষাদকে সঙ্গী করে বেলা থাকতে থাকতেই ফিরে যেতে হয় কাঁটাতারের ওপারের নিরাপত্তাহীন ভারতে। শারদ রাতে চরাচরের আকাশে যেন থরে থরে মেঘ জমে। দূর থেকে ঢাকের বাদ্যির আওয়াজ ভেসে আসে। বেদনাক্লিষ্ট হৃদয়ের বল্গাহীন রক্তক্ষরণে ভেসে যায় চর জীবন, যৌবন। মেঘের আড়াল ছিঁড়ে উঁকি মারা বাঁকা চাঁদের ঠোঁটও আক্ষেপে কেঁপে ওঠে। অব্যক্ত যন্ত্রণার ভারে তিরতির করে দুলে ওঠে নদীতীরের বৃক্ষবন। আধো জোছনা মাখা চরাচরে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট বিধাতা যেন বিড়বিড় করে বলে ওঠেন ‘পদ্মানদীর মাঝি’র সংলাপ— “পদ্মার বুক ভেদ করিয়া জাগিয়া ওঠে চর। জেলে পাড়ার ঘরে শিশুদের ক্রন্দনরোল কোনোদিন বন্ধ হয় না। হাসি-কান্নার দেবতা, ক্ষুধা-তৃষ্ণার দেবতা, প্রেম-ভালবাসার দেবতা, অন্ধকার আত্মার দেবতা... পদ্মানদীর চরে ইহাদের পূজা কোনোদিন সাঙ্গ হয় না।”

শীর্ণকায়া নদীর তিরতিরে স্রোত দুলতে থাকে অস্ফুট যন্ত্রণার ভার বুকে বয়ে। জীর্ণ টালির চাল বেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে থোকা থোকা বোবা কুমড়ো ফুল। মুগ্ধ প্রজাপতি ফিরে গেলে কাঁটাতারের ওপারের নিঝুম চরাচরে ঝুপ করে নেমে আসে গাঢ় সন্ধ্যা। ঝিঝি পোকা আর জোনাকির যুগলবন্দি মুখরিত করে রাখে ব্রাত্য চরাচর। থুরথুরে পেঁচার ডানায় লেগে থাকে শিউলির গন্ধ। ভেজা কামিনীর গন্ধ চরাচরময়। শারদ রাত যেন থমকে থাকে বুকফাটা হাহাকারের আবর্তে! যন্ত্রণা ক্লিষ্ট অনুভব গায়ে মেখে শিউলি ফোটা আর এক ঝকঝকে শারদ সকালের অপেক্ষায় বয়ে চলে আদুরী নদী। আর তার তরঙ্গের ঘূর্ণিপাকে পাক খেতে খেতে চরের জীবনগাঁথা নিরন্তর আন্দোলিত হয় ছলাৎ ছলাৎ অস্ফুট ক্রন্দনে। ঘুটঘুটে আঁধার এসে গিলে নেয় নির্বাসিত সহনাগরিকদের ইহকাল, পরকাল। শরতের অহল্যা বাঁশি যে কোন গৌতমমুনির অভিশাপে এমন বেসুরো স্বরে বেজে ওঠে এই অভারতের চরাচরে, কে জানে!

(লেখক বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজের বাণিজ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সিমলার ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি-র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট। মতামত ব্যক্তিগত।)

Powered by Froala Editor