শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েই অসংখ্য মানুষকে দিনবদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আরমান

জন্ম থেকেই হাঁটতে সমস্যা হয় আরমান আলির। হুইলচেয়ার তাঁর জন্মসঙ্গী। তবে বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে থাকতে কোনোদিন বুঝতে পারেননি তিনি বাকিদের মতো নন। বরং আরও চার ভাইবোনের সঙ্গে মিলেমিশে হৈ হৈ করে কেটেছে ছেলেবেলা। কিন্তু সমস্যা শুরু হল বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে না হতেই। প্রথম যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন আরমান, সেখানে শৌচাগার ছিল মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে। পাঁচটা সিঁড়ি টপকে তবে যেতে হত। অথচ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে কোনো কর্মচারীই সেদিন এগিয়ে আসেননি ছোট্ট ছেলেটাকে সাহায্য করতে। শেষ পর্যন্ত স্কুল ছাড়তে হল আরমানকে। কারণ, সেরিব্রাল পালসি নামক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত আরমান।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য একাধিকবার স্কুল বদল করতে হয়েছে আরমানকে। পড়াশোনার রাস্তাটা খুব সহজ ছিল না। তবুও জীবনের লড়াইটা ছেড়ে দেননি তিনি। আর আজ তাঁর হাত ধরেই সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন হাজার হাজার প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ। কর্মক্ষেত্রে যাতে আর পাঁচটা মানুষের মতোই সমান সুযোগ পান প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষরাও, সেটাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। দিল্লি কেন্দ্রিক ‘ন্যাশানাল সেন্টার ফর প্রমোশন অফ এমপ্লয়মেন্ট ফর ডিসএবলড পিপল’ সংস্থার কর্ণধার আসামের ভূমিপুত্র আরমান আলি। শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালে পাশ হওয়া আরপিডব্লিউডি আইনের নেপথ্যেও রয়েছেন তিনি। এমনকি তাঁর পরামর্শ মেনে নিতে স্বীকৃত হয়েছে দেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং নির্বাচন কমিশনও।

মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে আরমান দেশের নানা জায়গায় প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্য আয়োজিত বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলিতে ঘুরে বেরাতেন। বুঝতে চেষ্টা করতেন প্রতিবন্ধকতাকে নিয়ে সমাজের নানা রকমের দৃষ্টিভঙ্গি। ঠিক এরকম সময়, ১৯৯৮ সালে বেঙ্গালুরু শহরের একটি কর্মসূচিতে আরমানের সঙ্গে আলাপ হল জাভেদ আবিদির। জাভেদ তখন এনসিপিইডিপি-র কর্ণধার। তাঁর হাত ধরেই বাস্তব লড়াইয়ের মাটিতে পা রাখা আরমানের। রাজনৈতিক স্তরে লড়াই-আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই দাবি আদায় করে নিতে হবে, শিখিয়েছিলেন জাভেদ। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনি ব্যবস্থার দাবিতেও আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে আইনের খসড়া তৈরি হলেও তা কার্যকর হয়নি। জাভেদের নেতৃত্বে আরমান এবং বাকিদের আন্দোলনের ফলেই শেষ পর্যন্ত আইন কার্যকর করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এবং এই আইনের চূড়ান্ত খসড়া তৈরির কমিটিতেও ছিলেন আরমান আলি।

তবে এইসব লড়াইয়ের পাশাপাশিই চলেছে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের লড়াইও। শরীর ঠিক রাখার জন্য তাঁকে নিয়মিত জিমে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। অথচ তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার অজুহাতে কোনো জিমেই শেষ পর্যন্ত সদস্যপদ পেলেন না তিনি। অবশেষে নিজের উদ্যোগেই খুলে ফেললেন একটি আস্ত জিম। সেখানে শুধুই প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষরা সদস্যপদ পেতে পারেন। এছাড়া সরকারি মহলে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে প্রতিনিয়ত। তাঁর সুপারিশ অনুযায়ী তৈরি হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতির সর্বশেষ খসড়াটি। সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সার্বিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেও কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তবে আরমান বিশ্বাস করেন, আইনি স্তরের লড়াইটাই শেষ নয়। বরং তা সামগ্রিক লড়াইয়ের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ। আসলে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষরা সবচেয়ে বেশি সম্মানের অভাব বোধ করেন। আর এই সম্মনা অর্জনের লড়াইটা লড়তে হবে সমাজ বদলের মধ্যে দিয়েই।

আরও পড়ুন
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তৈরি ক্যাফে, ধুঁকছে লকডাউনের পরেও

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
হুইলচেয়ারে বসেই ফটোগ্রাফি, ক্যামেরাকে সঙ্গী করে প্রতিবন্ধকতা জয় খড়গপুরের শুভ্র-র