চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই

‘নাটক করবি?’

বাল্যবন্ধুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। জীবনে বেশ কয়েকবার নাটক করেছি। তবুও অ- আ-ক-খ রপ্ত হয়নি। মঞ্চে ভালোভাবে দাঁড়াতে পারি না। হাঁটাচলা দূরের কথা। স্বরক্ষেপণে দুর্বল। গলায় অল্প সুর খেলে। কিন্তু স্মৃতিশক্তি ভুলিয়ে দেয় সংলাপ। যাই হোক। অ্যামেচার থিয়েটার। ঘরোয়া পরিবেশনা। কলাকুশলীরাও অ্যামেচার। রাজ ডাঙা বোসপুকুর সংলগ্ন দুস্থ শিশুদের নিয়ে একটি দল। নাম অন্তরাস। সেই দলেই মিলল রোল। প্রতি সপ্তাহে মহড়া। এবং অবিমিশ্র ভুল। বন্ধুর মাসি ডিরেক্টর। প্রতিদিন জোটে বকুনি। এবং দিদি সোহিনী দাশগুপ্ত। আমাদের ‘দি-ভাই'। নাচ সেখান ছেলেমেয়েদের। তাঁর অনবদ্য নাচ, অঙ্গচালনা, হাঁ হয়ে দেখি। নাচের মাধ্যমে অনেককিছুই মুখে না বলেও বলা যায়, বুঝতে পারি।

মাঝে মাঝে মহড়ায় আসতেন টাকমাথা এক ভদ্রলোক। খুঁটিয়ে দেখেন। মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে বলেন, ‘এদিকটা একটু দেখো।’ বুদ্ধদা। উনিই অন্তরাসের জীবনীশক্তি। মহড়া শেষে হাসির হররা। মুড়ি-চানাচুর, নিমকি। নানা আজগুবি গল্প বলেন বুদ্ধদা। ওঁর যুবাবয়সে টিউশন পড়ানোর গল্প। আমরাও সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে উঠে টিউশনি খুঁজছি। সেসব অভিজ্ঞতা কেমন যেন মিলে যায় অবিকল। আসলে কিছু কিছু ব্যাপার প্রজন্মের পর প্রজন্ম বদলায় না।

এর মধ্যেই লোভে পড়ে রসগোল্লা তোলেন বুদ্ধদা। দলের সবচেয়ে ছোট্ট সদস্যটিও হাঁ হাঁ করে ওঠে। ডিরেক্টার মাসিমনি রেগে যান, ‘আবার খাচ্ছেন? আপনার না…’ বলে বিদঘুটে পাঁচ-ছ'টা অসুখের নাম আওড়ান। বুদ্ধদার চোখ চকচক করে। ‘আহা, তাই বলে মিষ্টিটা…’

আরও পড়ুন
বাঁশবাগানের মাথার ওপর

সিনেমা বলতে আমার জগৎ তখন ব্রুস লি, জ্যাকি চ্যান, হলিউড।  বাংলা দূরের কথা, হিন্দি ছবিও দেখি না। কানে সারাক্ষণ বাজে বিদেশি গান। কাজেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নামটা অজানা। বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘একি, দেখিসনি? নিম অন্নপূর্ণা দেখে ফেলিস।’ বাবার কথা আর কেই বা শুনেছে।

আরও পড়ুন
শাচানতলার উপকথা – দ্বিতীয় পর্ব

মহড়ার শেষে গাড়িতে ওঠেন বুদ্ধদা। বন্ধুটি কানে কানে বলে ‘চলে যা, ওঁর গাড়িতে।' হাটখরচের টানাটানি তখন। রাজডাঙা থেকে যাদবপুর দুটো অটো। ভাড়া অনেক। কাজে কাজেই হ্যাংলার মতো চেপে বসি। বুদ্ধদাও অনাহুত অতিথিকে স্বাগত জানান। রাত্রি ১০টা বাজে। উৎকণ্ঠা মেশা গলায় বলেন, ‘অটো পাবে?’ 

আরও পড়ুন
শাচানতলার উপকথা – প্রথম পর্ব

পাশাপাশি বসে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক। আর ফার্স্ট ইয়ারের এক ছোকরা... গড়িয়াহাট চলে এলো। দশটা কুড়ি। অন্ধকার চিরে বুদ্ধদার গাড়ি মিলিয়ে যায়।

তপন থিয়েটারে নাটক শেষে বুদ্ধদা উঠে আসেন মঞ্চে। তাঁর চোখ দুটো ঝকঝক করে… ‘ভালো করেছ…’

তারপর বেড়ে উঠি দুজনেই। আমি আর আমার বাল্যবন্ধু। এর দু-একবার মধ্যেও দেখা হয়েছিল। মনে রেখেছিলেন…

‘চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই।’

বুদ্ধদা কোথায় পৌঁছে গিয়েছেন, তার কোনো খবর নেই আমার কাছে।

Powered by Froala Editor