ইশতেহার

(প্রথম পর্ব)

      - হ্যালো কাকা? বলছি শোনো না, আমাদের পাড়ার বোবা গো-- বোবাকে চেন তো? সিকান্তকাকার দাদা গো, বুঝলেনি?
      - ওরে হ্যাঁ আমি চিনি, কী হয়েছে সেটা বল।
      - বোবা না, পাগল হয়ে গেছে। মা কা-লী বলছি কাকা, বিস্‌সাস করো, পুরো পাগলাচোদা হয়ে গেছে।

রাজেশের কোনো মাত্রাজ্ঞান নেই। ওর কথারও কোনো ছিরি-ছাঁদ নেই। কার সঙ্গে কীরকম আচরণ করতে হয়, কাকে কী বলতে হয়, - সেসব এটিকেট ও শেখেনি কখনও। ও যাকে বলে আশ্চর্য রকমের সরল এবং আশ্চর্য রকমের গোঁয়ারও বটে। এই জন্যে রাজেশকে আমি পছন্দ করি। গ্রামে না থেকেও আমি যে গ্রামের কার কী হল, কোথায় কী কেচ্ছা রটল, কার বিয়ে থাওয়া হল, কি ছেলেপুলে হল বা কেউ মারা গেল, কে কোন পার্টি জয়েন করল, কি দল বদলাল - ইত্যাদি সমস্ত খবরা-খবর সম্পর্কে আপডেট থাকতে পারি, সেই আপডেট থাকার সোর্স ওই রাজেশ। তো সেদিনটা ছিল ছাব্বিশ জানুয়ারি দুহাজার একুশ। দিল্লির রাজপথে রাষ্ট্রীয় কুচকাওয়াজ ছাপিয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের ট্রাকটর অভিযানের খবর সমস্ত মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। জুবুথুবু শীতে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ট্রাকটর অভিযানের সেইসব গরম গরম আপডেট নিচ্ছি। ফেসবুক জুড়ে অসংখ্য ভাইরাল ভিডিও একের পর এক আছড়ে পড়ছে। মিম ভেসে আসছে -থমথমে মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ কৃষকদের চাপে ভেঙে যাচ্ছে একের পর এক পুলিশি ব্যারিকেড। ঐক্যবদ্ধ হাতগুলো দৈত্যের মতো ডাম্পারগুলোকে জাস্ট ঠেলে রাস্তা থেকে হটিয়ে দিয়ে ট্রাকটরগুলোকে রাস্তা করে দিচ্ছে। দেখতে দেখতে তেরঙ্গা হাতে লালকেল্লায় ঢুকে পড়েছেন একদল কৃষক। অস্ত্রধারী পুলিশকে এতটা অসহায় কবে আর দেখেছে দেশবাসী! ভাবছি, কফি-কাপে এমন তৃপ্তির চুমুক আমিই বা কবে দিয়েছি। এমন সময়েই রাজেশের ফোন এলো, - কাকা, আমাদের পাড়ার বোবা পাগল হয়ে গেছে। মা কালী বলছি কাকা, বিশ্বাস করো, পুরো পাগলাচোদা হয়ে গেছে।

       - পাগল হয়ে গেছে বুঝলি কী করে?
      - হ্যাঁ গো, বিস্‌সাস করো, বাজারে গিয়ে হুই-হাই করে হাত-পা ছুঁড়ে কীসব বলছে। মাথায় একটা গামছাকে পাগড়ির মতো করে বেঁধেছে, আর লাঠিটা মাইকের মতো মুখের সামনে নিয়ে বক্তৃতা মারছে। বোবার কথা কেউ বুঝতে পারো বলো? সে কাণ্ড দেখে একদম লোক জমে গেছে। বাস-লরি সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে। বুঝলে কাকা, সে মানে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে লোকে। বোবার ছেলে গো সিমন্ত - জানো তো? সিমন্ত গিয়ে বোবাকে ধরে আনতে পারছে না। ওর বাবা গেছে, তাও আসবে না। সেই হোউ-হোউ করে বক্তৃতা মেরেই যাচ্ছে - মেরেই যাচ্ছে। পুরো পাগলাচোদা হয়ে গেছে। 

আরও পড়ুন
শাচানতলার উপকথা – দ্বিতীয় পর্ব

      - তারপর কী হল?
      - তারপর দুকুরবেলা কাকি গিয়ে--মানে বোবার বউ, মানে সিমন্তর মা - গিয়ে ধরে নিয়ে এল।
      - তা কেন পাগল হয়ে গেল কিছু বুঝলি? একটা কিছু কারণ তো থাকবে?

আরও পড়ুন
শাচানতলার উপকথা – প্রথম পর্ব

      - বাপি কাকার বউ বলছিল, কাল তিনসন্ধেবেলায় দিঘির উত্তরপাড়ে কবরের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিল, সেই সময় মুসলমানদের জিন ধত্তে পারে। তবে আমার মনে হয় কি কাকা, ওই সব জিন-টিন নয়, ওকে কেউ গাঁজা-ফাঁজা খাইয়ে দিয়েছে। 

      - আগে কোনোদিন এরকম কিছু হয়েছিল, মানে ওরকম কোনো পাগলামি করেছিল?

      - না গো, আগে কোনোদিন তো এমনি করেনি। না-না, হ্যাঁ, কদিন আগেই একদিন কেমন কচ্ছিল, আমার সেদিন সন্দেহ হয়েছিল, বুঝলে?

       - কী করছিল? 

      - কদিন আগেই গো, সন্ধেবেলা ক্লাবে টিভি দেখতে এসে ঝামেলা কচ্ছিল। আমরা একটা সিনেমা দেখছি, সে ক্যালা কিছুতেই আমাদের সিনেমা দেখতে দেবে না, রিমোর্টটা কেড়ে নিয়ে শুধুই হুট-হাট চ্যানেল পাল্টে দিচ্ছে। আর ওই ব্যা-ব্যা করে বক্তৃতা মারার মতো কী সব বলছে। 

      - কোন চ্যানেল দিচ্ছে?

      - খালি উল্টো-পাল্টা হিন্দি আর ইংরেজি খবরের চ্যানেল নিয়ে চলে আসছে। আর ওই ব্যা-ব্যা বক্তৃতা দিচ্ছে। ক্যালা কী বলছে আমরা কীকরে বুঝব। শেষকালে রাজুদা ব্যা-ব্যা করে কী সব ভুজুং ভাজুং দিয়ে বুঝিয়ে ঘর পাঠালে। এখন আর কাকা, আমরা থাকলে ক্লাবে আসে না, দুকুরবেলা একা একা টিভি দ্যাখে। কাকা, শোনো না, বলছি কি, তুমি একবার এসো। তুমি তো বোবাদের কথা বুঝ, তুমি বুঝবে বোবার কী হয়েছে, মানে কী বলতে চাইছে।    

রাজেশের ফোন আমার তাড়িয়ে তাড়িয়ে কৃষকদের দিল্লির পথে ট্রাকটর অভিযানের গরম গরম লাইভ আপডেটের সুখানুভুতিকে কেমন যেন ভোঁতা করে দিল। ফোন রেখে আমি কিছুক্ষণ চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, কী হল বোবার! ওরকম অদ্ভুত আচরণের কারণই বা কী! 

মনটা কেমন যেন একটু অস্থির হয়ে রয়েছে। বিকেলে ময়না-দার চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। ফেসবুক স্ক্রল করে যাচ্ছি বটে, কিন্তু কিছুই দেখছি না। দিল্লির বুকে কৃষকদের ট্রাকটর নিয়ে অমন দাপিয়ে বেড়ানো, লালকেল্লার বুকে তিরঙ্গার পাশাপাশি শিখদের নিশান সাহিব পতপত ওড়ার দৃশ্য এবং সে নিয়ে সরকারপক্ষ আর বিরোধীপক্ষের বিরোধ-সমর্থনের টানাপোড়েন ইত্যাদি কোনো পোস্টই আর আমার মনোরঞ্জন করতে পারছে না। উঠে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে মোহনবাগান মাঠের দিকে গেলাম। অনিমেষের ফোন এল, —স্যার, সন্ধ্যায় একবার যাব? থিসিসের থার্ড চ্যাপটারটা লিখতে গিয়ে একটু অসুবিধা হচ্ছে, একটু আলোচনা করতাম। বললাম—অনিমেষ, একটু ব্যস্ত আছি। সামনের সপ্তাহে আয়। ভাবছি, আমারই সমবয়সী—আমার থেকে বড়োজোর বছর দুয়েকের বড়ো হবে হয়তো—এতো শান্ত শিষ্ট গোবেচারা জন্মাবধি বোবা-কালা একজন মানুষের হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কী এমন কারণ থাকতে পারে!  আমি দাদাকে ফোন করলাম—হ্যাঁ রে, শুনেছিস? বোবা নাকি পাগল হয়ে গেছে? কিছু জানিস?

দাদাও মোটামুটি ওই রাজেশের সুরেই কথা বলল। ওর ধারণা বোবার মাথা খারাপই হয়েছে। কদিন থেকেই না কি একে ওকে দেখলেই কীসব বোঝানোর মতো করে বকে যেত। বকে যেত মানে হাত-পা ছুঁড়ে লেকচার দেওয়ার মতো, যদিও আদতে তা ওই বোবা-চিৎকার—খালি হোউ হোউ করা। একদিন দাদাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে ওইরকম হোউ হোউ করে লেকচার দিতে শুরু করেছিল। যেন গভীর কোনো বক্তব্য বোঝাতে চাইছিল। কিন্তু কার সাধ্য ওর হোউ-হোউ বোবা-চিৎকার বোঝে! লোকে যে ওর ভাষা আদৌ কিছু বুঝছে না, এটাই আসলে বোবা বুঝতে পারে না। দাদা ঘাড় নেড়ে হাঁ-হুঁ দিয়ে—যেন সব বুঝতে পেরেছে—এমনভাবে মাথা-টাথা নেড়ে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছে। কবে নাকি পুব পাড়ার মতিনকে ধরে আচ্ছা করে পিটিয়েছে। বোবার লেকচার শুনতে শুনতে ওকে নকল করেই মতিন হ্যা-হ্যা ফ্যা-ফ্যা করে হাসছিল, বো-বো স্বরে ব্যঙ্গ করছিল। বোবা হঠাৎ ওর জামার কলার ধরে দুমাদুম ঘুসি মারতে শুরু করে। সে রেগে না কি মেরেই ফেলত! রক্তারক্তি কাণ্ড! বোবা মানুষ, তাই ছেড়ে দিয়েছে, না হলে পুব পাড়ার লোকেরা ওকে মারধরই করত। সেই ঘটনার পর থেকে বোবাকে দেখলেই নাকি লোকে দূর থেকে ছুটে পালায়। আজ বাজারে গিয়ে যেটা করেছে, সেটা আর স্পেশাল কাউকে ধরে বোঝানো নয়, যেন প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে না কি বলছিল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, - বোবা যে বকুলের ধানকলে জনমজুরের কাজ করত, সেটা কি এখন করে?

      - হ্যাঁ, কাজ-কম্ম ঠিকই করে। এই তো ধান কাটা-ঝাড়া হচ্ছে, ও তো রোজই কাজে যায়। কাজের সময় ওরকম করে না। মাঠের কাজ না থাকলে বকুলের ধানকলে চলে আসে। বকুল যখনই ডাকে, ঠিক চলে আসে। কাজের বেলায় সেসব ঠিক আছে, এমনকী বাড়িতেও বউ-এর সঙ্গে বা ছেলের সঙ্গে কোনো খারাপ কিছু করে না, একেবারে স্বাভাবিক। কিন্তু ঘর থেকে বাইরে এলেই ওই যাকে দেখছে, লেকচার দিতে শুরু করছে। 

আমি আর কথা বাড়ালাম না, দাদাকে বললাম, - শোন, আমি কাল যাচ্ছি।        

ভুঁইয়া পাড়া। আমার বাড়ি থেকে বড়ো জোর একশো মিটার দূরত্ব। বলতে গেলে ঢিল ছোঁড়া দূরেই। অথচ আজ প্রায় ষোলো বছর হল সে পাড়ায় পা দেওয়া হয়নি। ছোটোবেলায় কতদিন এই পাড়ায় এসে পড়ে থেকেছি। মায়ের মুখে শুনেছি, বেলা হলে ভুঁইয়াবুড়ি পিসি এসে বলতেন—কই গো মেজো বউদি, একটা ঢেচকি দাও, গরম গরম চিঁড়ে এনেছি এক সের। 

ঢেঁকি-কোটা চিঁড়ে মায়ের ঢেচকিতে ঢেলে, বিনিময়ে নিতেন দুটো আধুলি কিংবা পোয়াটেক চাল। তারপর আমাকে কোলে করে নিয়ে চলে যেতেন তাঁদের পাড়ায়। সে পাড়ায় আমাকে নিয়ে পিসি খানিক এ-ঘর খানিক ও-ঘর করতেন। পিসির মা ছিলেন মকর-মা, সারা বুক জুড়ে ছিল উলকি—প্রাচীন জনজাতির কৌম জীবনের নিজস্ব চিহ্ন। মকর-ঠাকুমা আমাকে আদর করলে আমি তাঁর বুকে আঁকা উলকির উপর হাত বোলাতাম। ঠাকুমা আমাকে নিয়ে রঙ্গ করতেন, বলতেন— তোরা চিনতে লাড়ছিস, এই আমার কত্তা বটে। আমার ছোটো কত্তা। 

পিসির কুঁড়ে ঘরের দাওয়ায়-উঠোনে আমি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতাম। খিদে পেলে পিসি আমাকে যত্ন করে খাইয়ে দিতেন। 

সেই কোন আদিতে—তা প্রায় আশি-একশো বছর তো হবেই—পশ্চিম থেকে দুই একটা পরিবার উঠে এসে মোগলমারির সুপ্রাচীন এই দিঘির পাড়ে প্রথম বসবাস শুরু করেছিল। অধিকাংশই নিম্নবর্ণের ভূমিহীন কৃষক। রুখা-শুখা মাটির দেশ ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে কেউ কেউ চলে আসেন শস্য-শ্যামলা বর্ধমান জেলার দক্ষিণ-দামোদরের আশেপাশের গ্রামে। সেই ভাবেই আমাদের এই গ্রামের এক প্রান্তে দিঘির পাড়ে এসে বসবাস শুরু করেন রাধু পাল ও কালীপদ পালের বাবা। এঁরা কিন্তু ভুঁইয়া ছিলেন না, প্রান্তিকও ছিলেন না, এসেছিলেন জামালপুর থানার অন্তর্গত কোনো এক গ্রাম থেকে। এর পর বাঁকুড়ার প্রান্ত থেকে আসেন তিলক রায় ও মথুর রায়-এর পূর্বপুরুষ। ক্রমে সংসার বাড়ে,  দু-এক ঘর বাড়তে বাড়তে তৈরি হয় ছোট্টো একটা পাড়া—আমরা বলতাম ভুঁইয়া পাড়া। 

'ভুঁইয়া' অর্থাৎ ভুঁই বা ভূমি, আরেক অর্থ হল জমিদার। অর্থাৎ প্রভূত ভূ সম্পত্তির অধিকারীরাই হলেন ভুঁইয়া। মোগল আমলে বাংলার বিখ্যাত বারো ভুঁইয়ার ইতিহাস সুবিদিত। সম্রাট আকবরের আমলে ভুঁইয়াদের সম্পত্তির পরিমাণ অনুসারে বড়ো মেজো ছোটো প্রভেদ ছিল। অবশ্য 'ভুঁইয়া' জাতি বা বংশের এই ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের ভুঁইয়া পাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলেই মনে হয়। তথাপি এ পাড়ার নাম কেন যে ভুঁইয়া পাড়া হল, তার কোনো সূত্র আমি খুঁজে পাইনি। ভুঁইয়াদের কোনো কোনো গোষ্ঠী বহুকাল আগে জমিদারদের লেঠেল বাহিনীর সর্দারি করত। তাঁদেরকে বলা হতো ভুঁইয়া সর্দার। এঁদের পূর্বপুরুষ কেউ সর্দারি করতেন কি না, সেকথা কেউ আর বলতে পারেন না। এঁদের কারও পদবী ভুঁইয়া নয়, জাতিগত সূত্রে এঁরা হলেন পশ্চিমা বাউরি এবং আদতে ছিলেন মধ্য ভারতীয় দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। ইংরেজ আমলে বন-জঙ্গল-পাহাড় কেটে পরিষ্কার করে বসতি স্থাপনের জন্য উত্তর ও মধ্য ভারত থেকে বাংলায় দলিতদের নিয়ে আসা হয়েছিল। এদের মধ্যে বাউড়িদের অবস্থান মূলত বাঁকুড়া পুরুলিয়ার প্রান্তিক গ্রামগঞ্জে। 

প্রাচীন এই কৌম জনজাতিরা ছিলেন ভূমিহীন, মূলত খেতমজুর। চাষবাসের সময় অন্যের খেত-খামারে জনমজুরের কাজ করা আর বাকি সময়ে ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চিঁড়ে উৎপাদন করে বিভিন্ন গ্রামে-গ্রামে ফেরি করে বেড়ানো—এই তাঁদের জীবিকা আমি ছোটোবেলায় দেখেছি। অবশ্য সে-সব দিন আর নেই। আমি বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছি ঢেঁকিজাত পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে উঠে গেছে। বাস ও ট্রাকের খালাসি ও ড্রাইভারি করে পালেদের কেউ কেউ বেশ সম্পন্ন হয়েছেন, দু-চার কাঠা চাষের জমিও কিনেছেন। ফাঁকা জায়গায় উঠে গিয়ে বাড়ি করেছেন। বাজারে চায়ের দোকান করেছেন কেউ। কিন্তু বাউরিদের অধিকাংশ পরিবার আজও নিছক দিনমজুর, আজও তাঁরা থেকে গেছেন দারিদ্রসীমার নিচেই। পঞ্চায়েতের কল্যাণে গালার গাঁথনি করা ইঁটের দেওয়ালের উপর অ্যাসবেসটসের ছাদটুকু তবু হয়েছে কারও কারও। আর ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে লোকমুখে পাড়ার নামটুকু আজও টিকে আছে।

দিঘির ঢালু পাড়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা কুঁড়ে। পৌষের রৌদ্রস্নাত দুপুর অথচ এ পাড়ায় আজও বড়ো আলোর অভাব। সংকীর্ণ অসমান রাস্তাঘাট, এঁদো ডোবার পাড়ঘেঁষে ছড়িয়ে থাকা নোংরা আবর্জনা, পঞ্চায়েতের কল্যাণে সংযোজিত দু একটা নতুন ঘর—বিশ বছরে খুব বেশি বদল তো দেখছি না। তবু এ পাড়ায় ঢুকে নিজেকে আউটসাইডার মনে হচ্ছে। বোবার ঘরের সামনে গিয়ে আমি ইতস্তত করছি, এমন সময় চটের পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এলেন মথুর কাকা। আমার দেখা বরাবরের ক্ষীণস্বাস্থ্য মধ্যবয়সী সেই মানুষটা আজ বৃদ্ধ হয়েছেন। বললাম, —কাকা, আমাকে চিনতে পারছ? 

মথুর কাকা তাঁর ছানি-পরা ঘোলাটে চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। রান্নাঘরের চালা থেকে ঘোমটার আড়ালে উঁকি মেরে দেখছেন মথুরের বউমা। পাশের ঘর থেকে ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন বৃদ্ধা ভুঁইয়াবুড়ি পিসি। পিসি একদণ্ড আমার দিকে চেয়ে প্রফুল্ল হাসি হেসে বললেন, —আমাদের মলাই গো, চিনলে না? রক্ষিতদের মেজো বৌদির ছেলে, কেমন আছিস রে বাবা? আয় বোস। ছেলেবেলায় এ পাড়ায় কত এসেছিস। 

      মথুরকাকা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো একগাল হেসে বললেন, —চিনতে পারব কী করে, এক গাল দাড়ি হয়েছে যে। 

      পিসি তাঁর দাওয়ায় একটা চাটাই পেতে বললেন, —বোস বাবা। কবে এসেছিস?

      - এই তো পিসি, এই দুপুরেই এলাম। খোকার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। শুনলাম সব।

বলতে ভুলে গেছি, বোবার ডাক নাম খোকা। ছোটো থেকে ওকে খোকা বলেই ডাকত সবাই। এই খোকার বাইরে ওর ভালোনাম যে কী, বা আসল নাম আদৌ কিছু আছে কি না—সেই সন্ধান কেউ নেয়নি আজ পর্যন্ত। তবু সবার কাছে 'খোকা' থেকে ও যে কীভাবে নিছক 'বোবা' হয়ে উঠল, আমি জানি না। ভাগ্য ভালো, এই মুহূর্তে ওকে আমি 'বোবা' বলে সম্বোধন করে বসিনি। 

       - আর বাবা কী যে হবে! কই গো বউমা, খোকা কোথায়? ওকে ডেকে দাও।

      - এই মাত্র কাজ থেকে ফিরল। ঘাটে চান কত্তে গেছে।

      - কী হয়েছিল, কাকা?

      - কী জানি, কিচু তো বুজতে পাচ্চি না। এরম তো করে না কখনো। উকে তো কেউ কুনোদিন আমরা রাগতেই দেকিনি। 

      - বোবাকালা মানুষ, কুনোদিন কুনো সাতে পাঁচে থাকে না। কাজকম্ম লিয়েই থাকে। সেই মানুষের এ কী হল বল দিকিনি বাবু! ভুঁইয়াবুড়ি পিসি খুব দুঃখ করলেন।

পিছনে তাকিয়ে দেখি, বাপির বউ চুপিচুপি এসে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতিটা হালকা করার জন্য বললাম, - কাকা, খোকার ঘর কোনটা?

মথুরকাকা আঙুল নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন, দু কুটুরি কুঁড়ের ডানদিকের ঘরটায় থাকে খোকা, আর পাশেরটায় কাকিকে নিয়ে থাকে কাকা।

      - এই চালাটা নতুন হয়েছে বুঝি?

এবার সংকোচ ভেঙে কথা বলল খোকার বউ, - হ্যাঁ, পাটি থেকে টাকা পেয়েছিনু, ওতেই করেচি। এখানটায় রান্না হয়, আর ওপাশে আমার মেয়ে রয়েছে এখন। নাতি হয়েছে। 

খোকার বউকে আমি দেখেছি তার বিয়ের পরে। মাথায় ঈষৎ লম্বা সেই কিশোরীর শরীর জুড়ে ছিল আশ্চর্য উজ্জ্বল শ্যামলিমা। আনত মুখখানি যেন কবেকার টুসু গানের মতো করুণরসে মাখা। ভরা দিঘির জলে শ্রাবণের মেঘ যেমন খেলা করে, তেমনই দেখেছি তার গভীর দুই চোখ। আমি বললাম, - বউমা, তার মানে তুমি এখন ঠাকুমা হয়ে গেছ?

লাজুক হাসি হেসে বউমা আমার দিকে চাইল। শুধোলাম, ছেলে কোন ক্লাসে পড়ছে? 

-    নাইনে উঠেচে। একদম পড়তে চায় না দাদা। তার উপর লকডাউন বলে বই নিয়ে বসেই না।

বলতে বলতেই খোকা স্নান সেরে খালি গায়ে গামছা পরে এসে হাজির। আমাকে দেখেই হাত তুলে ইশারায় কুশল জানাল। পৌষের দুপুর, শীত আছে যথেষ্টই। আমি ইশারায় ওকে পোশাক পরতে বললাম। বউমা ঘরের ভিতর থেকে একটা লুঙ্গি আর জামা এনে দিল। 

পোশাক চেঞ্জ করে খোকা আমার সামনে দাঁড়াল। আমি ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে তোর? খোকা হাত নেড়ে হোউ হোউ করে আমাকে বোঝাতে শুরু করল।  ইশারায়—হাত নেড়ে— ও যা বোঝাতে চাইছে, সেটা যে খুব সিরিয়াস, সেটা ওর শরীরী ভাষাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। বার বার উত্তেজিত হয়ে সে কখনও হাত তুলে বহুদূরবর্তী কারও সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছে, কখনও হাতটাকে মুখের সামনে রিপিটেডলি বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খারাপকিছুর একটা পুনরাবৃত্তি বোঝাতে চাইছে। একবার কাস্তে হাতে ধান কাটবার ভঙ্গি করছে তো একবার গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরানোর মতো কী যেন বোঝাতে চাইছে। আমি মাঝখানে একটি বার ওকে শান্ত হতে, চুপ করতে বললে সে একেবারে আগুন হয়ে উঠল। তখন ডান হাত মুঠো করে বাঁ হাতের চেটোর উপর হাতুড়ির মতো ঘা মেরে মেরে যেন কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে লাগল, আবার কখনও হোউ হোউ শব্দ করে ডান হাত ছুঁড়ে কাউকে দূরে ভেগে যেতে বলছে। খোকার তখন রুদ্রমূর্তি। চোখে যেন আগুন জ্বলছে, সে আগুন সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। ওর রুদ্রমুর্তি দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। 

-    এই থাম তুই - এই বলে মথুরকাকা ওকে থামাতে এলে, খোকা ওর বাঁ হাত প্রসারিত করে, আঙুল দেখিয়ে প্রায় অবজ্ঞা করার মতো বাপকে ঘরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল। 

আমি রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে গেছি। না পারছি খোকাকে থামাতে, আর না বুঝতে পারছি ওর কোনো ইশারা বা কোনো বক্তব্য। সেই সময়টিতে বউ এসে খোকার সামনে দাঁড়াল। চিৎকার নয়, হাত ধরে টেনে আনা নয়, জবরদস্তি নয়, চোখে চোখ রেখে সে একমুহূর্ত খোকার দিকে তাকাল। সে দৃষ্টিতে কী ছিল জানি না, দেখলাম, খোকা শান্ত ছেলেটির মতো আমাকে ছেড়ে ঘরে ঢুকে গেল। বউমা বলল, - দাদা, ভাত বেড়েছি, ও এখন ভাত খাবে। আপনি অন্য সময় করে আসবেন।

-    ঠিক আছে বউমা, তুমি ওকে আগলে রেখো। আমি পরে একদিন আসব।

      চলে আসার সময় দেখি খোকার বাড়ির বাইরে, রাস্তার ধারে কৌতূহলী প্রতিবেশীদের উঁকি ঝুঁকি। 

-    দাদা, কবে এলেন গো?

      তাকিয়ে দেখি বাপির বউ, হাসি মুখে আমাকে ডাকছে। বললাম, - এই তো কিছুক্ষণ আগেই।

-    দাদা, বোবাকে জিন ধরেছে, বুঝতে পারলেন? পরশু দিন তিনসন্দেবেলা কবর স্থানের উপর দিয়ে হেঁটে আসছিল, সেই সময় মাথার উপর তিনবার প্যাঁচা ডেকে ডেকেছিল, আমি ঘাটের পাড় থেকে দেকেচি।

বললাম, - বউমা, এই খবরটা আর ছড়িও না। জিন খুব খারাপ জিনিস। একজনকে ছাড়ে তো আর একজনকে ধরে। মেয়েদের দেখলে তো আর কথাই নেই।

কথা না বাড়িয়ে আমি চলে এলাম। বার বার খোকার ওই আগুনে মূর্তি মনে পড়ছে। সেই ছোটো বেলা থেকেই দেখেছি, কখনও দেখিনি খোকা রেগে গেছে কিংবা অস্বাভাবিক কিছু আচরণ করছে। বোবা-কালা ছেলেটি প্রধানত চেনা লোকজন ছাড়া বিশেষ কথা বলত না। আর কথা মানে একতরফা হোউ হোউ করা। উল্টোদিকের মানুষটির কোনো কথা খোকা বুঝত না, তেমনি সেই মানুষটি তার কথা আদৌ কিছু বুঝছে কি না, তাকে ব্যঙ্গ করছে কি না বা খিস্তি দিচ্ছে কি না - সে সবও খোকা বুঝত বলে মনে হয় না। বরং ওকে নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ করলে, সেই লোকটির সঙ্গে খোকাকেও দেখেছি হ্যা হ্যা করে হাসতে।

অথচ এমন নয় যে বোবাকালা মানুষরা কিছু বোঝেন না। আমার বাবা - জন্মাবধি বোবাকালা ছিলেন, তিনিই তো আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। উল্টোদিকের আলাপি মানুষটা তাঁর কথা বুঝতে না পারলে, বাবাকে দেখেছি সেটা ধরে ফেলতেন এবং আবার বোঝাতেন, প্রয়োজন হলে কাগজ পেন নিয়ে লিখে দিতেন। মানুষের ঠোঁট নাড়া দেখেই বুঝে নিতেন কী বলছেন তিনি। তাঁকে ব্যঙ্গ করলে তো আর রক্ষে ছিল না, রেগে তাঁকে এই মারেন তো সেই মারেন। ইশারায় 'তুমি খারাপ', 'তুমি বাজে' বলে তাঁকে দূর দূর করে দিতেন। অবশ্য বাবার মতো শিক্ষাগ্রহণের সৌভাগ্য খোকার হয়নি। গ্রামের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত খোকাকে যেতে দেখেছি। বই এর পাতায় আঙ্গুল দিয়ে, কিরবিয়া মাস্টারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একসুরে হোউ হোউ করতেই দেখেছি। আমি নিশ্চিত, সেই পাঠে বাংলা অক্ষরের সঙ্গে কোনো পরিচয়ই তার হয়নি। চটের থলে নিয়ে কিছুদিন ইস্কুলের চারদেয়ালে আসা যাওয়ার পর খোকার পড়াশোনায় দাড়ি পড়ল। কখনও ছাগল-গোরু চরানো, কখনো বাবার সঙ্গে মাঠের কাজ শেখা ইত্যাদি করার পর দশ এগারো বছর বয়সে পাড়ার গুলফ্যাক্টরিতে মজুরের কাজে ঢুকে গেল খোকা। সেই থেকেই চলছে তার কায়িক শ্রমের জীবন। এ-হেন নিরীহ গোবেচারা খোকার জীবনের পঁয়তাল্লিশটা  বছর এমন নির্বিঘ্নে পেরিয়ে যাওয়ার পর কী এমন ঘটল, যে লোকটা পাগল হয়ে গেল!

ভগ্ন মনোরথে আমি বর্ধমান ফিরে গেলাম।

Powered by Froala Editor