লোকাল ট্রেনের সঙ্গে জড়িয়ে বইপাড়ার ব্যবসাও, সুদিনের খোঁজে পুরনো বইয়ের বিক্রেতারা

“এখন সবাই বাড়িতে বসে অনলাইনে বই কিনছেন। কিন্তু প্রকাশকদের পক্ষে, বা যাঁরা নতুন বই কিনছেন তাঁদের পক্ষে অনলাইন ব্যবসা যতটা সহজ, আমাদের পক্ষে তেমনটা একদমই নয়।” বলছিলেন দীপঙ্কর দত্ত। কলুটোলা স্ট্রিটে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ঠিক পাশের সিঁড়িটিতে বইয়ের পসরা নিয়ে আজও এসে বসেন তিনি। তাঁর মতো সমস্ত পুরনো বই বিক্রেতারাই এখনও রোজ এসে বসেন নিজের নিজের জায়গায়। শুধু বইয়ের পসরার সামনে ঝুঁকে পড়া ক্রেতাদের ভিড়টা নেই। করোনা অতিমারী এসে সবটাই এলোমেলো করে দিয়ে গিয়েছে।

তবুও অতিমারী পরিস্থিতিতে অনলাইন বিপণনের মাধ্যমকেই বেছে নিয়েছেন পুরনো বইয়ের বিক্রেতারাও। হাজার হাজার বই, তাদের প্রত্যেকের পাতায় পাতায় লুকিয়ে রয়েছে আরও কত ইতিহাস। কোনো বইয়ের প্রকাশ হয়তো আজ থেকে ৫০ বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোনো বইয়ের মাত্র একটিই সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সেইসব অজস্র বাংলা বইয়ের হিসাব রাখেননি কেউই। বেহিসাবী হয়েই একটু একটু করে তারা এসে জমা হয়েছে কলুটোলা স্ট্রিটে। কীভাবে অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে এইসব বই? দীপঙ্করবাবু জানালেন, “স্যোসাল মিডিয়ায় (মূলত ফেসবুকে) সবারই নিজের নিজের গ্রুপ আছে। দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে সেই গ্রুপে নতুন নতুন বইয়ের ছবি তুলে পোস্ট করা হয়। তারপর ক্রেতারা যোগাযোগ করেন।” কিন্তু পুরনো বইয়ের খাঁটি ক্রেতারা আজও বই হাতে না নিয়ে কিনতে চান না বলেই মনে করছেন তিনি।

“একটা সময় পুরনো বই মানুষ কিনতেন সস্তায় পাওয়া যেত বলে। এখন কিন্তু সেই ধারণাটা কিন্তু বদলে গিয়েছে। বিশেষ করে পিডিএফ আসার পর আর সেই চাহিদা থাকল না।” বলছিলেন দীপঙ্করবাবু। কিন্তু তার বদলে পুরনো বইয়ের প্রকৃত পাঠকরা জায়গা ফিরে পেলেন। দীপঙ্করবাবুর কথায়, “তাঁরা ঘর সাজানোর জন্য বই কেনেন না। তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের স্তূপ ঘেঁটে পছন্দের বই বেছে নিয়ে যান। সেইসব বই আর কোথাও পাবেন না বলেই এখানে আসেন।” কিন্তু স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁদের সামনে সমস্ত বই এভাবে মেলে ধরতে পারছেন না বলে আক্ষেপ থেকেই যাচ্ছে বিক্রেতাদের।

তবুও প্রতিদিনই জনা কুড়ি ক্রেতা আসছেন। একটার পর একটা দোকান ঘুরে হয়তো পছন্দের কোনো বই খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁদের জন্যই রোজ এখানে আসছেন বিক্রেতারা। কিন্তু এভাবে কতদিন ব্যবসা চলবে, জানেন না কেউই। এর মধ্যেই অনেকে বইয়ের ব্যবসা ছেড়ে বইয়ের হোম ডেলিভারি বা অন্যান্য পেশায় চলে গিয়েছেন বলে জানালেন দীপঙ্করবাবু। আগেও অবশ্য অনেকে মাঝপথে ব্যবসা ছেড়ে চলে যেতেন। কিন্তু তাঁদের সংগ্রহের সমস্ত বই দিয়ে যেতেন অন্য একজন নতুন বিক্রেতার হাতে। এই মরা বাজারে নতুন কোনো বিক্রেতাও এগিয়ে আসছেন না। তাহলে কোথায় রাখবেন এই বইয়ের সম্ভার? দীপঙ্করবাবু শুধু জানেন, “লোকাল ট্রেন চালু হলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। নাহলে সব সম্পদ হয়তো হারিয়েই যাবে একদিন।” তবু যক্ষের মতো তাকে পাহাড়া দিয়ে যেতে হবে কয়েকজনকে। এই অতিমারী পরিস্থিতিতে তাঁদের ভূমিকা এটুকুই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More