মাদুরশিল্পের হাত ধরেই জাতীয় পুরস্কারজয়ী পশ্চিম মেদিনীপুরের দুই মহিলা

আজ থেকে কয়েক দশক আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে অতিথিকে বসতে দেওয়ার জন্য সোফাসেট ছিল না। বাড়ির দাওয়ায় বিছিয়ে দেওয়া হত মাদুর। আজও গ্রামাঞ্চলে সেই প্রথা থেকে গিয়েছে। কত না নকশা তোলা মাদুর, তাদের রঙেরও কত বাহার। কিন্তু এইসব শিল্পীদের খবর আর কজনই বা রাখতেন? গ্রামের মহিলাদের হাতে প্রতিদিন প্রাণ পেত মাদুর। তবে এইবার ধীরে ধীরে মিলছে স্বীকৃতি। আর সম্প্রতি জাতীয় হস্তশিল্প মেলায় পুরস্কৃত হতে চলেছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দুই মাদুরশিল্পী গৌরীরানি জানা এবং গৌরীবালা দাস। গত স্বাধীনতা দিবসের দিনই তাঁদের নাম ঘোষণা করে কেন্দ্র সরকার।

বাংলার প্রায় সর্বত্রই মাদুর তৈরির চল থাকলেও দুই মেদিনীপুর জেলায় তার রেওয়াজ সবচেয়ে বেশি। এমনকি মাদুর তৈরির জন্য যে ঘাস ব্যবহার করা হয়, চলতি ভাষায় যার নাম মাদুরকাঠি, তাও এই দুই জেলাতেই সবচেয়ে বেশি জন্মায়। ২০১৮ সালে মাদুরকাঠিকে মেদিনীপুরের সম্পদ হিসাবে জিআই তকমাও দেওয়া হয়। এই সময় থেকেই একটু একটু করে মাদুর বিপণনের বাণিজ্যিক দিকটির দিকেও নজর দেওয়া শুরু হয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে মাদুর তৈরির চিরাচরিত প্রথাও। মাদুরের পাশাপাশি মাদুরকাঠির আসনের ব্যবহার ছিল আগেই। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ল্যাপটপ কভার, চায়ের ট্রে, কাপবোর্ড, ব্যাগ ইত্যাদি আধুনিক সব সরঞ্জাম তৈরি। সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে মহিলারা গড়ে তুলেছেন নিজেদের দল। গৌরী রাণি জানা এবং গৌরীবালা দাসেরও আছে এমনই দুটি কারখানা। দুজনেই পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও তাঁদের কারখানাদুটি রয়েছে সবং শহরে। একেবারে ছোটো অবস্থা থেকে শুরু করে আজ সেখানে ৬০ জনের উপর কর্মচারী কাজ করেন।

ধীরে ধীরে মাদুর ব্যবসা যখন নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই এসে গেল করোনা অতিমারী। ফলে অন্যান্য ব্যবসার মতোই মার খেতে হল মাদুর শিল্পকেও। এমনিতে এখনও মাদুরকাঠির শৌখিন পণ্যের চেয়ে সস্তা মাদুরপাটির বিক্রিই বেশি। আর তা সাধারণত ফেরি করেই বিক্রি করা হয়। অতিমারী এবং লকডাউনের কারণে বিপণনের এই রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে একেবারে। তার মধ্যেই দুই শিল্পীর পুরস্কারপ্রাপ্তি নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে।

জাতীয় হস্তশিল্প মেলার এই পুরস্কারপ্রাপ্তি মাদুর শিল্পের বিকাশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেই মনে করছেন সকলে। বাংলার হারিয়ে যেতে বসা শিল্পগুলিকে এভাবে বিশ্বের সামনে হাজির করা না গেলে অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা মুশকিল। আর মাদুর শিল্পের সঙ্গে যেহেতু মূলত মহিলারাই যুক্ত, তাই এর ফলে মহিলাদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার রাস্তাটাও অনেকটাই প্রসারিত হবে। প্রতি বছরই জাতীয় হস্তশিল্প মেলায় পুরস্কৃত করা হয় বেশ কয়েকজন শিল্পীকে। তবে একই শিল্পের সঙ্গে জড়িত দুজন একই বছর পুরস্কার পাচ্ছেন, এমন ঘটনা বিরল। নানা দিক থেকেই তাই এবছরের এই পুরস্কার উল্লেখের দাবি রাখে। আর বাংলার মানুষের কাছে, বিশেষত গ্রামবাংলার যে মানুষরা আজও মাদুর আঁকড়ে ধরে বাঁচেন, তাঁদের কাছে এ এক খুশির খবর তো বটেই।

আরও পড়ুন
শঙ্খে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ খোদাই করে জাতীয় পুরস্কার বাঁকুড়ার শিল্পীর

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
জাতীয় হকি দলের 'দায়িত্বে' ওড়িশা সরকার, জার্সিতেও উজ্জ্বল নাম