মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়েই ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দেন দুর্গা!

দুর্গার বিদেশভ্রমণ - ৫

মা দুর্গার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে আছে বিশ্বের অসংখ্য দেশে। ব্রিটেনেই পুজো হয় প্রায় ৪৫টি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লন্ডন শারদ উৎসব(নিউ ব্রডওয়ে), সাউথ লন্ডন সার্বজনীন দুর্গাপূজা(সারে), উইম্বলডন কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন(উইম্বলডন), সনাতন বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন(নিউ বার্নেট), লন্ডন দুর্গাপূজা অ্যাসোসিয়েশন (হ্যাম্পস্টেড), লন্ডন দুর্গাপূজা দশেরা কমিটি (বিডবরো স্ট্রিট), রামকৃষ্ণ বেদান্ত সেন্টার(বর্নি এন্ড), রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন(বোল্টন) উল্লেখযোগ্য। কথা হচ্ছিল রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের সদস্যা সোমা ঘোষের সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘বোল্টনে আমাদের পুজো একদম ঘরোয়া পরিবেশে হয়। পুজোর জোগাড় করা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবেতেই থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। পুজোর দিনগুলোতে নিয়মনিষ্ঠাভরে পুজো করা হয়। অঞ্জলি, সন্ধি পুজো থেকে শুরু করে নবমীর দিন কুমারীপুজাও হয়। মহালয়ার দিন এখানকার মহিলারা মিলে মহিষাসুরমর্দিনী ডান্স ড্রামা পরিবেশন করেন। দশমীতেও থাকে অনুষ্ঠান। সেখানে কলকাতা থেকে যেমন শিল্পীরা আসেন তেমনি এখানকার ছেলেমেয়েরাও অংশ নেয়।’

আরও পড়ুন
ঢাকের বদলে ড্রাম, জমাটি দুর্গাপুজো সিংহের দেশ আফ্রিকায়

এছাড়া আমেরিকার ডেনভার শহরের বাঙালি সমিতি ‘মিলনী’র উদ্যোগে আশির দশকে দুর্গাপুজো শুরু হয়। পুজোর সময় কলকাতা থেকে সঙ্গীত শিল্পীরা আসেন। খাওয়াদাওয়া, সাজগোজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছু নিয়ে রমরম করে শনি-রবি দু-দিন ধরে পুজো হয়। শনিবার ষষ্ঠী সপ্তমীর পুজো, রবিবার নবমী দশমীর। রবিবার ঢাকের তালে বাচ, সিঁদুরখেলায় মেতে ওঠেন সকলে। সবই তো হল, কিন্তু পুজোর আসল লোক অর্থাৎ পুরোহিত আসে কোথা থেকে? সোমাদেবীর কথায় ‘আমাদের পুরোহিত এখানকারই দুই বাঙালি ডাক্তার ড. শিশিরকুমার মুখার্জি ও ড. বিনয় চক্রবর্তী।’

অ্যারিজোনা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজো

অন্য দেশগুলিতেও প্রায় একই ব্যাপার। প্রতিমা কুমারটুলিতে থেকে গেলেও প্রবাসে বসবাসকারী ব্রাহ্মণরাই সাধারণত পুজো করেন, সারা বছর বিভিন্ন পেশায় যাঁরা নিযুক্ত। তবু কিছু পুরোহিত যে কলকাতা থেকে যান না তা নয়। বিদেশের বেশ কিছু বারোয়ারিই কলকাতা থেকে তিন-চার জনের পুরোহিতদল ভাড়া করে নিয়ে যায়। এই সমস্ত পুরোহিতদের সঠিকভাবে পুজোর আচার শেখানোর জন্য বৈদিক পণ্ডিত ও পুরোহিত মহামিলন কেন্দ্র প্রতিবছর মানিকতলার রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটে এক কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানে শুধু বিদেশে পুজো করতে যাওয়া পুরোহিত নয়, কলকাতায় পুজো করা পুরোহিত এবং তাদের সহকারীদেরও বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই সংস্থার প্রধান পণ্ডিত নিতাই চক্রবর্তীর কথায়, ‘সন্ধিপুজোর সময় পুরোহিতদের প্রয়োজন হয় সঠিক আচার জানা সহকারীর। কারণ মাত্র ৪৮ মিনিটের মধ্যে সন্ধিপুজো সম্পন্ন করতে হয়। এই পুজোর আয়োজনও খুব বেশি। ১০৮টা পদ্মের পাপড়ি খোলা, ১০৮টি প্রদীপ জ্বালানো, নৈবেদ্য, ভোগ, আরতি, বলিদান দেওয়ার সমস্ত আয়োজন জানা না থাকলে যা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর জন্য প্রয়োজন সঠিকভাবে পদ্ধতি জানা সহকারীর। কলকাতার প্রায় সমস্ত বারোয়ারিরই যা নিয়ে অভিযোগ থাকে। সঠিক সহকারী না থাকলে পুরোহিতের পক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুজো সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।’

শিকাগো বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজো

বিশ্বজুড়ে বাঙালির দুর্গা যে শুধু কুমোরটুলি থেকেই বিদেশে পাড়ি দেয় এমন নয়। কুমোরটুলি ছাড়াও কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, কীর্ণাহার থেকেও প্রতিমা বিদেশে যায়। তবে একটা ব্যাপার সব জায়গাতেই এক। বিদেশে দেবী মৃণ্ময়ী অর্থাৎ মৃৎনির্মিতা নন। প্রায় সব জায়গাতেই হয় শোলা, নাহয় পাল্প অথবা ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা যায়। এ-কারণেই কি বিদেশে পাড়ি দিলে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক এক অর্থে কমে আসে তাঁর?

আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা ইংল্যান্ড ছাড়াও সংখ্যার বিচারে বিদেশে সবচেয়ে বেশি পুজো হয় আমেরিকাতে (৩০টি), জার্মানি (১০টি), জাপান (২০টি), অস্ট্রেলিয়া (৮টি), ইন্দোনেশিয়া (৪টি), মালয়েশিয়া (৫টি), নাইজেরিয়া (৩টি), ত্রিনিদাদ আর টোবাগো (৫টি), কানাডা (৬টি), সিঙ্গাপুরে (৪টি)। এছাড়াও হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ভার্জিনিয়া, নিউজিল্যান্ড, হংকং, মোজাম্বিক, চিন, নরওয়ে, সুইটজারল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডেও একটি বা দুটি করে পুজো হয়।

ব্রিটেনের এডিনবরার পুজো

এখানেই যে মা দুর্গার ছানাপোনা-সহ মর্ত্যের বিদেশভ্রমণ শেষ, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। হয়তো আমাদের জানার বাইরেও রয়ে গেছে এমন কিছু অজানা দেশ বা দ্বীপ, পৃথিবীর মানচিত্রে যাদের আতশকাচেও দেখা যায় না। তবু বাঙালির পায়ের ধুলো একেবারেই পড়েনি কি সেইসব অখ্যাত আর অতি ক্ষুদ্র দেশে? দেখা যাবে সেখানেও ঠিক রয়ে গেছে কিছু বাঙালি। আর কে না জানে তিনজন বাঙালি এক জায়গায় হলেই সেখানে একটি দুর্গাপুজো শুরু হতে দেরি হয় না। যেমন, পাপুয়া নিউগিনির মাদাংগে, বা হাইতির পোর্ট-অ-প্রিন্সে। তাই বং কানেকশনের উপর বিশ্বাস রেখে মা দুর্গার আগমনে গলা ছেড়ে বলে উঠুন – ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’, কেননা দেখা যাচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই সর্বত্র বিরাজমান তিনি।

অকল্যান্ডের পুজো

More From Author See More