জাতীয় পুরস্কার পেয়েও অনালোচিত সুদীপ্ত-ফারহা; মান কমছে সিনেমাপ্রেমী বাঙালির?

একটা ঘুড়ি উড়ছে। একটা ঘুড়ি কেটে গিয়ে আটকে আছে গাছের ডালে। একটা সবুজ পাখি খাঁচার দেওয়াল ঠোকরাচ্ছে। সে কি মুক্তি চায়? মুক্তি তো চায়… ভারতের অগুনতি মহিলা। কিংবা একটা রামধনু রঙের রোদ। নিয়মের, সংবিধানের, কিংবা, ধর্মগ্রন্থের জুজু দেখিয়ে যেই রোদ্দুরদেরকে বাধ্য করা হয়েছে পুরুষতন্ত্রের যাবতীয় একচোখামি সহ্য করে নিতে। এই বেড়াজাল ভেঙে ফেলারই গল্প বলে ‘হোলি রাইটস’ কিংবা ‘লাডলি’। বাঙালি পরিচালকদ্বয় ফারহা খাতুন এবং সুদীপ্ত কুন্ডুর ভাবনায় সময় নির্ভর উল্লেখযোগ্য দলিল বলাই যায় যে ছবিগুলোকে।

সদ্য প্রকাশিত চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ফারহা খাতুন পরিচালিত ‘হোলি রাইটস’ এবং সুদীপ্ত কুন্ডু পরিচালিত ‘লাডলি’। সামাজিক যেসব বিষয় ভাবিয়ে তোলে আমাদের, সেই বিভাগেই সেরা ছবির সম্মান পেয়েছে এই দুটি ছবি। ইয়ং ফিল্ম মেকার বলতে যেটা বোঝায়, ফারহা এবং সুদীপ্তকে সেই গোত্রে ফেলা যায় অবশ্যই।

তিন বছরের মধ্যেই দু’দুটো জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন ফারহা। এর আগে ২০১৮ সালে ‘আই অ্যাম বনি’ ছবির জন্যেও জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিষয়গত ভাবে ‘হোলি রাইটস’ যেন আঘাত করতে চেয়েছে ভারতীয় সমাজে ছড়িয়ে থাকা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালীন অচলায়তনে। ‘তিন তালাক’! যে শব্দবন্ধে নিমেষে খর্ব হয়ে যায় মুসলিম নারীর অধিকার। যে কোনো সময় ‘প্রাক্তন স্ত্রী’-র তকমা লেগে যেতে পারে তাঁর গায়ে! ২০১৭ সালে ‘তাৎক্ষনিক তিন তালাক’ (ইনস্ট্যান্ট তিন তালাক) ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৯ সালে পাশ হয় তিন তালাক বিরোধী বিল। তবুও ভারতীয় মুসলিম সমাজের থেকে কি পুরোপুরি দূর হয়েছে এই অভিশপ্ত প্রথা?

এই প্রশ্নকে ভিত্তি করেই মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান ফারহা তাঁর দলবল নিয়ে। ক্যামেরায় দেবলীনা এবং প্রিয়াঙ্কা সহজ সাবলীলতায় ধরেছেন প্রতিটা মুহূর্ত। শব্দ গ্রহণ করেছেন সব্যসাচী পাল। সাফিয়া আখতার নামের এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম মহিলাকে ঘিরে আবর্তিত হয় ‘হোলি রাইটস’-এর দৃশ্যপট। ভারতে যেভাবে প্রচলিত ছিল তিন তালাক প্রথা, তা যে কতটা সারমর্মহীন এবং স্বয়ং কোরান যে তাকে সমর্থন করে না, সেটাই ধরে ধরে মুসলিম মহিলাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, মুসলিম মহিলারা যে ‘কাজী’ হতে পারবেন, সেই প্রশিক্ষণ শিবিরেরও অন্যতম মুখ ছিলেন সাফিয়া। বলাই বাহুল্য, এই লড়াইটা সহজ ছিল না। কিন্তু কত সহজে সেই লড়াইয়ের গল্প সামনে তুলে আনলেন নবীন চিত্রপরিচালক! এই সম্মান মানবাধিকারের প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে তাঁকে আরও বেশি কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবেন বলে মনে করছেন পরিচালক নিজেই।

আরও পড়ুন
সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা ‘চঞ্চু’, ছক ভাঙার নেপথ্যে আবীর রায়

কিন্তু আচমকা কেন এমন একটি বিতর্কিত বিষয়কে বেছে নেওয়া? ফারহার বক্তব্যে উঠে আসে ব্যক্তিগত যন্ত্রণার গল্প। উঠে আসে, কীভাবে নিজের এক আত্মীয়া তাঁর স্বামী দু’বার ‘তিন তালাক’ বলে ফেলার পর তৃতীয়বার উচ্চারণের আগেই স্বামীর মুখ চেপে ধরে নিজের বিয়ে টিকে রেখেছিলেন, সেই গল্প। সেই ভীষণ আতঙ্ক কীভাবে দীর্ঘদিন কুরে কুরে খেয়ে ছিল তাঁকে, তা অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। রূপকলা কেন্দ্রের প্রাক্তনীকে তখন থেকেই ভাবিয়ে তুলেছিল সামাজিক এই ব্যাধি।

আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলির ইতিহাস ধরে রাখছেন হেমন্ত

মজার কথা হল এইবারে জাতীয় পুরস্কারের তালিকায় যথেষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বাংলা। জনপ্রিয় পরিচালক সৃজিত মুখার্জির ‘গুমনামি’ এবং কৌশিক গাঙ্গুলীর ছবি ‘জ্যেষ্ঠ পুত্র’ পেয়েছে জাতীয় পুরস্কারের সম্মান। জাতীয় পুরস্কারে মনোনীত হয়েছেন চলচ্চিত্র সম্পাদক অর্জুন গৌরাসিয়া, ‘শাট আপ সোনা’ চলচ্চিত্রের জন্য। সামাজিক বিষয় নির্ভর চলচ্চিত্রের জন্য সম্মানিত হয়েছে ফারহা খাতুনের ‘হোলি রাইটস’ এবং আর এক তরুণ বাঙালি পরিচালক সুদীপ্ত কুন্ডুর ছবি ‘লাডলি’। এছাড়াও সেরা প্রমোশনাল ফিল্মের জন্য সম্মান পেয়েছেন পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায় এবং সেরা লোকেশন সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন সপ্তর্ষি সরকার। সোহিনী চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সমালোচকের পুরস্কার। 

‘লাডলি’ ছবির গল্পও এগোয় এই সমাজেরই আরেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিকে সামনে রেখে, ভদ্র সমাজ যাঁদের দিনে-দুপুরে ডেকে ওঠে ‘হিজড়ে’ বলে। বিহারের এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা লাডলি কীভাবে তাঁর তরুণ বয়সে বুঝতে পারে শারীরিক ‘অসম্পূর্ণতা’র কথা, কীভাবে জড়িয়ে পড়ে দেহব্যবসায়— সেই আলো-আঁধারি পুরো ছবি জুড়ে। তবে দহনের শেষে বৃষ্টির মতো ভালবাসাও আসে প্রায় চল্লিশ মিনিট দীর্ঘ ছবির শেষে।

আরও পড়ুন
সমপ্রেমের সিনেমা, সমকামী অভিনেতাকে নিয়েই ‘বাজিমাত’ হলিউডের

দিল্লির রাস্তায় মাঝরাতে এই ছবির মূল প্রোটাগনিস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল পরিচালক সুদীপ্তর, যিনি এই ছবির প্রযোজক এবং চিত্রগ্রাহকও। প্রাথমিক ভাবে একটা ছোট ছবির পরিকল্পনা থাকলেও, দৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়েছে ছবির নিজস্ব চলনে। জাতীয় পুরস্কার কতটা সাহস যোগাল? ভরসার কথাই শোনাচ্ছেন সুদীপ্তরা। যখন সমলিঙ্গে প্রেম বা বিয়ে নিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি দেশে, এমনকি সুদীপ্তও যেখানে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আবার ৩৭৭ ধারা পুরোদমে ফেরত আসে কিনা, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘লাডলি’ এক ঝলক টাটকা বাতাস অবশ্যই। অবশ্যই একটা লড়াই করার হাতিয়ার।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ফারহা বা সুদীপ্তর নাম সেভাবে কখনোই উঠে এল না প্রচারের আলোয়। পরিচিত জনপ্রিয় নাম নিয়েই মেতে আছে বাংলা সংবাদ মাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া। ফারহা বা সুদীপ্ত, দুজনের কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, এই বিষয়গুলো এখন আর আশ্চর্য করে না তাঁদের। ফারহার কথায়, দেশের সামগ্রিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কিংবা বিদেশে ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে এখনও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ধরে রেখেছে ডকুমেন্টারি ছবি। তবু কোথাও যেন এখনও ব্রাত্য হয়ে থেকে যাওয়াই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে ভারতীয় ডকু-ফিল্মমেকারদের। কোথা থেকে আসছে অনুপ্রেরণা তবে? কাজটাকে ভালবেসেই কাজ করে যাওয়া, জানাচ্ছেন দুই পরিচালকই। স্বাধীন ভাবে বানানো সেই ছবিই জাতীয় পুরস্কারের সম্মান পেলে, তাতে ভাললাগা একটা থাকেই তাই। কিন্তু সাধারণ দর্শকের কাছে সেই ছবি না পৌঁছালে কিংবা সংবাদ মাধ্যমে একটাও কথা না লেখা হলে, তা এখন আর ভাবায় না ফারহা বা সুদীপ্তকে। 

কিন্তু সাধারণ সিনেপ্রেমী বাঙালি দর্শক হিসেবে একটা খটকা থেকেই যায়। বৌদ্ধিক চলচ্চিত্রের সমঝদার হিসেবে বরাবরই সুনাম ছিল বাঙালির। কিন্তু সেই সুনামেও কী তবে মরচে পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই? নয়তো ফারহা বা সুদীপ্তর কাজকে আরও একটু সম্মান হয়তো জানানোই যেত!

Powered by Froala Editor

More From Author See More