কেউ বলেন ‘বুড়ির চুল’, কারোর কাছে ‘হাওয়াই মিঠাই’ - ১১৬ বছরেও অটুট নস্টালজিয়া

একটুকরো মেঘ যেন রূপকথার আকাশ থেকে উড়ে এসেছে। তাই তো মার্কিন দেশের সাহেবরা নাম দিয়েছেন 'ফেয়ারি ফ্লস'। আর আমরা আদর করে ডাকি 'বুড়ির চুল'। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়, তাই নাম 'হাওয়াই মিঠাই'। কেউবা আবার 'দাদুর দাড়ি' বলেও ডাকে। এই মিষ্টির কথা বলতে গেলেই যেন শৈশবের এক ঝাঁক নস্টালজিয়া এসে ভিড় করে। বাড়ির পাশ দিয়ে টুংটুং করে সাইকেল বাজিয়ে চলে যেত 'হাওয়াই মিঠাই', আর আমরা দ্রুত গেটের কাছে পৌঁছে হাত বাড়িয়ে নিতাম প্যাকেট মোড়া চারটে বা ছটা ছোটো-ছোটো গুলি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাজ বদলেছে এই খাবারটাও। এখন তাকে দেখতে পাওয়া যায় লম্বা কাঠির গায়ে জড়িয়ে। সেই চেনা সাদা আর গোলাপি রঙের সঙ্গে এসে গেছে নীল, সবুজ, সোনালি হরেক রং।

শৈশবের স্মৃতি মানেই তো অভিভাবকদের এককাদা 'না'। দাঁত খারাপ হয়ে যাবে, তাই খাওয়া যাবে না হাওয়াই মিঠাই। তখন তো কেউ বলে দেয়নি যে এই মিষ্টির আবিষ্কারক আসলে একজন ডেন্টিস্ট। ক্যান্ডি-মেকার জন সি. ওয়রটনের সঙ্গে মিলে ১৮৯৭ সালে ডেন্টিস্ট উইলিয়াম মরিসন তৈরি করেন একটা যন্ত্র। এই যন্ত্রেই চিনির দানা থেকে তৈরি হয় 'হাওয়াই মিঠাই'। ১৯০৪ সালে তাঁরাই সেন্ট লুই বিশ্বমেলায় হাজির হন নতুন এই খাবার নিয়ে। আর মেলায় আসা মানুষের মন জয় করে নেয় তখনই। প্রথম দিনেই বিক্রি হয়ে যায় ৬৮,৬৫৫ প্যাকেট। মার্কিন দেশে এই মিষ্টি এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে ৭ই ডিসেম্বর দিনটিকে 'ন্যাশনাল কটন ক্যান্ডি ডে' হিসাবে পালন করা হয়। ১৯২০ সালের মধ্যেই সারা পৃথিবী জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নতুন এই মিষ্টি, আর আবিষ্কারকদের দেওয়া নাম 'ফেয়ারি ফ্লস' পাল্টে গিয়ে ততদিনে 'কটন ক্যান্ডি'। অভিভাবকরা দাঁত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় দেখালেও, এই মিষ্টিতে চিনির পরিমাণ আদৌ বেশি নয়। বেশিরভাগটাই হাওয়া। আর সেজন্যই তো মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়।

বর্তমান বাজারে এই মিষ্টির হাল-হকিকত জানতেই, কথা বলে নিলাম বিক্রেতা সৌমেন রায়ের সঙ্গে। বিধাননগর পৌষ উৎসবে হওয়াই মিঠাই আর পপকর্নের স্টল নিয়ে উপস্থিত জগতপুর নিবাসী সৌমেন। জানা গেল, শুধু কচিকাচারাই নয়, আজকাল বুড়ির চুলের লোভ সামলাতে পারেন না তাদের অভিভাবকরাও। ‘মোটামুটি সব বয়সের মানুষের কাছেই এটা সমান জনপ্রিয়।’ বাজারে অনেকরকম নতুন খাবারের ভিড়ে এর ব্যবসা একটু কোণঠাসা হলেও, সৌমেনের কথায় চাহিদা খারাপ নয়। সেটা অবশ্য বোঝা গেল স্টলের সামনে ভিড় দেখেই। ‘রাস্তায় ঘুরে ঘুরে হওয়াই মিঠাই বিক্রি আজকাল আর হয় না। ঠান্ডা হলে, হাওয়া লাগলে স্বাদ খারাপ হয়ে যায়। তবে মেলায় মেলায় স্টল দিয়ে যেমন বিক্রি করি, তেমনি ডাক আসে নানান অনুষ্ঠানেও।’ কী ধরনের অনুষ্ঠান, জিজ্ঞেস করায় জানা গেল বিবাহ বা জন্মদিনের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠানেও ডাক আসে, আবার ছোটদের স্কুলে বড়দিনের অনুষ্ঠানেও ডাক আসে। সৌমেনের কাছেই জানা গেল, কলকাতায় বছর কুড়ি আগে এসেছে কটন ক্যান্ডি তৈরির মেশিন। তার আগে কি মধ্যযুগের ইউরোপের স্পান সুগার তৈরির মতো করেই তৈরি হত এই খাবার? সৌমেন সেই তথ্য জানাতে পারেননি যদিও। তবে এই মেশিনের সাহায্যে কটন ক্যান্ডি তৈরি করে যে অনেক বেকার যুবকই রোজগারের রাস্তা তৈরি করছে, তা বোঝা গেল।

সৌমেনের সঙ্গে কথা বলার পর তার কাছ থেকে বুড়ির চুল নিয়ে খেতে খেতে বেরিয়ে আসি মেলা থেকে। আর ভিড় করে আসে শৈশবের একরাশ নস্টালজিয়া। যেন স্পষ্ট শুনতে পাই টুংটুং শব্দে সাইকেলে চেপে চলে যাচ্ছে বুড়ির চুল...

More From Author See More