ব্রহ্মাণ্ডের জন্মলগ্নে 'ফেরা' কি সত্যিই সম্ভব?

গত মঙ্গলবারের কথা। ভারতে সবে ভোরের আলো ফুটেছে। হোয়াইট হাউসে রীতিমতো ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবি প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যা কিনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে ‘শার্পেস্ট’ ও ‘ডিপেস্ট’ ছবিও বটে। ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো ছায়াপথ ‘এসএমএসিএস-০৭২৩’-এর ছবিই ধরা পড়েছে এই ছবিতে। এ তো সবে শুরুয়াৎ। আরও প্রাচীন নক্ষত্র ও ছায়াপথের হদিশ দেবে মানুষের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ, আশাবাদী বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কত পুরনো গ্যালাক্সি-নেবুলাদের খুঁজে পাবে জেমস ওয়েব (James Webb Telescope)?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে, ঝালিয়ে নেওয়া যাক অন্য একটি বিষয়। মঙ্গল হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে জো বাইডেন মন্তব্য করেছিলেন জেমস ওয়েবের তোলা এই ছবিই ব্রহ্মাণ্ডের প্রাচীনতম খণ্ডচিত্র। বহু সংবাদমাধ্যমেও উল্লেখিত হয়েছে সে-কথা। যদিও তা সম্পূর্ণভাবে সত্যি নয়। তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে, এখনও পর্যন্ত মহাকাশের প্রাচীনতম ছবি তোলার ক্ষেত্রে জেমস ওয়েবের থেকে সামান্য হলেও এগিয়ে রয়েছে তার পূর্বপুরুষ হাবল। ২০১৭ সালে ১৩৪০ কোটি বছর বয়সি এক ছায়াপথের সন্ধান দিয়েছিল হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। তবে জেমস ওয়েবের তোলা প্রথম এই ছবির মাহাত্ম্য কী? কেনই বা মাতামাতি হচ্ছে তা নিয়ে?

জেমস ওয়েবের বিশেষত্ব হল, শার্পার ফোকাস। অর্থাৎ, হাবলের থেকেও আরও নিখুঁত ছবি তুলতে পারে জেমস ওয়েব। জুম করে স্পষ্ট করে তুলতে পারে দূরবর্তী মহাজাগতিক পদার্থের ছবি। আর তার জন্য দায়ী, ৬ মিটার দীর্ঘ সোনার পাত দিতে তৈরি প্রকাণ্ড আয়না। জেমস ওয়েবের তোলা প্রথম ছবিটি শুধুমাত্র ‘এসএমএসিএস-০৭২৩’ গ্যালাক্সিরই ছবি নয়, বরং সেখানে লুকিয়ে রয়েছে আরও বহু গ্যালাক্সি। নিঃসন্দেহে যারা প্রাচীন সংশ্লিষ্ট ছায়াপথটির থেকেও। নাসার অনুমান তাদের বয়স কমপক্ষে ১৩৩০-১৩৪০ কোটি বছর। তবে হিসাব করে তাদের বয়স নির্ণয় করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। 

এবার ফিরে যাওয়া যাক মূল প্রসঙ্গে। সবচেয়ে কত পুরনো ছায়াপথ বা নক্ষত্রের ছবি তুলতে পারবে জেমস ওয়েব? যদি কর্মজীবনের শুরুতেই এই টেলিস্কোপে ধরা পড়ে ১৩৩০ কোটি বছরের ইতিহাস, তবে কি বিগ ব্যাং-এর সময়ে কী ঘটেছিল সেই ঘটনাও ধরা পড়বে জেমস ওয়েবের চোখে? 

আরও পড়ুন
হাবল টেলিস্কোপে ধরা দিল দূরতম আইনস্টাইন বলয়

গাণিতিক বিশ্লেষণ, তাত্ত্বিক ও পরীক্ষালব্ধ গবেষণা বলছে, আজ থেকে ১৩৮০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং-এর সাক্ষী হয়েছিল মহাবিশ্ব। অর্থাৎ, জেমস ওয়েবের তোলা প্রথম ছবির সময়কাল থেকে পিছিয়ে যেতে হবে আরও প্রায় ৫০-৬০ কোটি বছর। তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে এত পুরনো গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রের ছবিও ক্যামেরাবন্দি করতে পারে জেমস ওয়েব। যা হাবলের দৃষ্টিসীমার বাইরে। কারণ, হাবল টেলিস্কোপ মূলত ক্যামেরাবন্দি করতে পারে দৃশ্যমান থেকে নিকট অবলোহিত বা নিয়ার ইনফ্রারেড আলোকে। অন্যদিকে জেমস ওয়েব কাজ করে নিটক থেকে মধ্য অবলোহিত আলোকতরঙ্গে। ফলে, অভিকর্ষের প্রভাবে অর্থাৎ স্থান-কাল বক্রতায় বেঁকে যাওয়া আলোকরশ্মিদেরও ধরতে পারে এই টেলিস্কোপ। কেন? মজার বিষয় বলে রাখা যাক। সদ্য ধরা পড়া এসএমএসিএস-০৭২৩ ছায়াপথের যে ছবি ধরা পড়েছে তা ১৩০০ কোটি বছর পুরনো। অর্থাৎ, আজ যে ছবি দেখতে পাচ্ছি তা এই ছায়াপথের ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো ছবি। সম্ভবত আজ সেই গ্যালাক্সি ধ্বংস হয়ে গেছে। সে যাই হোক না কেন, আদতে এই ছায়াপথের দূরত্ব পৃথিবী থেকে ৫১২ কোটি আলোকবর্ষ। কাজেই সাধারণ অঙ্কের হিসেবে এই ছায়াপথ থেকে আলো আসতে সময় লাগার কথা ৫১২ কোটি বছর। তাহলে ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো ছবি আমরা দেখছি কীভাবে? স্থান-কাল বক্রতার কারণেই। আলোর পথ বেঁকে যাওয়ায়, এই ছায়াপথ থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে। একইসঙ্গে অভিকর্ষের প্রভাবে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, দৃশ্যমান আলোর তুলনায় অবলোহিত আলোর দিকে ঘেঁষে তরঙ্গদৈর্ঘ্য। সেই কারণেই, হাবল ব্যর্থ হলেও এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ছবি ধরতে পারে জেমস ওয়েব। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশ্লেষণ করে, দূরবর্তী ছায়াপথের আসল রং-ও জানায় শক্তিশালী এই দূরবীক্ষণ।

আরও পড়ুন
টেলিস্কোপ হাতে ছুটতেন বাংলার গ্রামে-গ্রামে, বিদায়েও অনালোচিতই রইলেন এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী

তবে বাস্তবে জেমস ওয়েবের এমন ছবি আশা করা খানিকটা বোকামিই হবে। তার কারণ, বিগ ব্যাং-এর পর প্রায় ১০-৩০ কোটি বছর সময় লেগেছিল ছায়াপথ তৈরি হতে। মধ্যবর্তী সময়টায় ব্রহ্মাণ্ডজুড়ে ঘুরে বেড়াত গ্যাসের মেঘপুঞ্জ। অভিকর্ষের প্রভাবে ক্রমশ কাছাকাছি আসার ফলে, ঘূর্ণন গতির সৃষ্টি হয় এই মেঘপুঞ্জে। যা পরবর্তীতে চেহারা নেয় গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের। অনুমানিক প্রায় ১৩৫০-৬০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডে ঘটেছিল এই ঘটনা। সেই সময়টাকে বলা হয় ‘মহাজাগতিক ভোর’ বা ‘ইন্টারস্টেলার ডন’। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের দৌলতে বিগ ব্যাং-এর দৃশ্য দেখা সম্ভব না হলেও, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি আগামীদিনে হাতে পাবে মানুষ। তাতে সন্দেহ নেই কোনো। মহাজগতের ইতিহাস অনুসন্ধানে তার গুরুত্বই বা কম কি? 

Powered by Froala Editor

More From Author See More