টেলিস্কোপ হাতে ছুটতেন বাংলার গ্রামে-গ্রামে, বিদায়েও অনালোচিতই রইলেন এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী

মফস্বল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম, ছোটো বড়ো সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন এক প্রৌঢ়। কখনও তাঁর হাতে থাকছে একটি টেলিস্কোপ, কখনও বেশ কিছু স্লাইড। এটুকুই ছিল সম্বল; আর তা দিয়েই সবাইকে বিজ্ঞানে দীক্ষিত করতেন ওই প্রৌঢ়। প্রথমদিকে হয়ত সন্দেহ ছিল গ্রামের ওই মানুষগুলোর; কিন্তু একটা সময় পর একেবারে ঘরের মানুষ হয়ে যান তাঁরা। তবে ওই প্রৌঢ় শুধু আকাশের তারা চিনিয়েই ক্ষান্ত হন না। বুজরুকি, ঝাড়ফুঁক, অন্ধবিশ্বাস আমাদের মনকে কীভাবে আচ্ছন্ন করছে, কীভাবে ক্ষতি করছে, পিছিয়ে দিচ্ছে আমাদের— সেটাও দৃপ্ত কণ্ঠে প্রচার করতেন। সেই বলিষ্ঠ আওয়াজই হঠাৎ থেমে গেল। হাতে ধরে বিজ্ঞান শেখানোর মানুষটা নিজেই তারা হয়ে গেলেন। ডঃ অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু বাংলার বিজ্ঞানশিক্ষা, বিজ্ঞান সচেতনতার জগতে একটা বিরাট শূন্যতা তৈরি করল তাতে সন্দেহ নেই।

এপার বাংলাতেই জন্ম তাঁর। বাগনানের মুগকল্যাণ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি— যাত্রাটা ছিল অন্যান্য মেধাবী ছাত্রদের মতোই। কিন্তু সেটুকুই অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্পূর্ণ করে না। ছোটো থেকেই একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এই যে খোলা আকাশ, তার ভেতরে জেগে আছে অসংখ্য তারা, এই পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময় লাগত তাঁর। এমনকি এর বাইরেও আরও কত কি ছড়িয়ে আছে ব্রহ্মাণ্ডে, সেটা জানার পর রহস্যের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল। আর সেখানেই ডুব দিলেন অমলেন্দুবাবু। আকাশ ভরা সূর্য তারার মাঝেই খুঁজে পেলেন নিজের মুক্তি। অ্যাস্ট্রোনমি বা জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু হল তাঁর। 

নিজের ৯০ বছরের জীবনে অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। মেঘনাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত ‘নটিকাল অ্যালমানাক ইউনিট’-এর দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। মূলত তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পর এই সংস্থা ভারতের একটি আন্তর্জাতিক মানের পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে এমপি বিড়লা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে যুক্ত হন, এখানেই শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন তিনি। কলকাতার বিড়লা তারামণ্ডলকে আধুনিক রূপদানের পেছনেও অন্যতম মানুষ ছিলেন তিনি। বিদেশের নামীদামি সব অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সাম্মানিক ফেলোও ছিলেন তিনি। 

তবে ডঃ অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রধান অবদান ছিল বাংলায় বিজ্ঞান প্রসার নিয়ে। এত বড়ো বিজ্ঞানী, কিন্তু ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সাধারণ। জীবনযাপনেও কোনোরকম বিলাসিতা ছিল না। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ বিজ্ঞানকে গ্রহণ না করলে এর সার্বিক বিস্তার সম্ভব নয়, এটা বুঝেছিলেন তিনি। আর সেজন্যই নিজের উদ্যোগে পৌঁছে গিয়েছিলেন এইসব মানুষের কাছে। সঙ্গে থাকত টেলিস্কোপ, আর বেশ কিছু স্লাইড। সবাইকে সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন বিজ্ঞানের বিষয়। রাতের আকাশ চেনাতেন হাতে ধরে। বাংলার সমস্ত জায়গাই চষে ফেলেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, বই লিখেছেন, অনুষ্ঠানও করেছেন; মানে যতভাবে বিজ্ঞানকে ছড়ানো যায় তার সব রাস্তাতেই হেঁটেছেন তিনি। সেইসঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আমাদের ভেতরের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়েই এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে যাচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে বিজ্ঞানের। এই কথাটাই সবসময় বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এখন সেই আওয়াজ থেমে গেল বরাবরের মতো। তারার দেশেই চলে গেলেন ‘তারাদের বন্ধু’ ডঃ অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More