মাথার দাম ১৭ হাজার মার্কিন ডলার, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে আমাজন-রক্ষার লড়াই ওসভালিন্দা-র

প্রতিদিন সকাল হলেই বাড়িতে বন্দুক নিয়ে হাজির হত ভাড়াটে জল্লাদরা। অপরাধ ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বননিধনের বিরুদ্ধে। তবু সরে আসেননি তিনি লড়াই থেকে। মৃত্যু পরোয়ানাকে তুচ্ছ করেই করে গেছেন প্রতিবাদ। এবার সেই সাহস এবং প্রকৃতি-রক্ষার জেদকে সম্মাননা জানাল সুইডেনের সংস্থা। প্রথম ব্রাজিলের নাগরিক হিসাবে ওসভালিন্দা আলভেস পেরেইরা পেলেন মানবাধিকারের অন্যতম পুরস্কার এডেলস্টাম প্রাইজ।

আমাজন ব্রাজিলের পারা প্রদেশের এরেইয়া গ্রামে বসবাস ওসভালিন্দার। শহুরে বসতি আর সংরক্ষিত ঘন আমাজন অরণ্যের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রাম। ঠিক যেন অরণ্যের প্রাচীর। তবে এই প্রাচীর ভেদ করেই হয়ে চলেছে বৃক্ষচ্ছেদন। এই গ্রামের রাস্তাই হয়ে উঠেছে অনৈতিক বন-নিধনকারীদের প্রবেশের পথ। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেই গ্রামবাসীদের সম্মুখীন হতে হত নির্যাতনের। এমনকি কখনও কখনও মৃত্যুরও।

দীর্ঘদিন ধরেই পারা প্রদেশের এই প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক হয়ে আসছে। ১৯৮৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পারা প্রদেশে জমি-বিবাদ এবং বন-নিধনে প্রতিবাদ করার জন্য মারা গিয়েছেন ৭০০-র বেশি গ্রামবাসী। তবে বিচার হয়েছে মাত্র ২২টি ক্ষেত্রে। বাকিদের বেকসুর খালাস করেছে প্রশাসন। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতারাই যে এই ঘটনার পিছনে রয়েছে, তারই ইঙ্গিত দেন স্থানীয় ক্যাথোলিক গির্জার প্যাস্টোরাল ল্যান্ড কমিশন। তবে সম্প্রতিককালে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বৃক্ষচ্ছেদন। ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর আইন প্রণয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে ছাড় দেওয়ার পরই এই বাড়-বাড়ন্ত। 

তবে ২০২০-র শেষ লগ্নে এসে ওসভালিন্দা এই পুরস্কার পেলেও, তাঁর লড়াই চলছে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে। শুধুমাত্র বৃক্ষচ্ছেদনের প্রতিবাদই নয়, নিজে আমাজনের দুর্লভ, মূল্যবান গাছেদের সংরক্ষণের উদ্যোগও নিয়েছিলেন ওসভালিন্দা। নিজের ব্যক্তিগত জমিতেই সবুজায়ন করে সংরক্ষণ করেছিলেন আমাজন চিরহরিৎ অরণ্যের হারিয়ে যেতে থাকা কিছু প্রজাতির। ২০১২ সালে গ্রামের মহিলাদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি সংস্থাও। চলত অরণ্য সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ। সেইসঙ্গে বন-নিধনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সেনানী তৈরির কাজও চালাত এই সংস্থা।

অনৈতিক বৃক্ষচ্ছেদনকারীদের কাছে কিছুদিনের মধ্যেই অন্যতম লক্ষ্য হয়ে ওঠেন ওসভালিন্দা। তাঁদের অনৈতিক ব্যবসায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান তিনিই। প্রথমে তাঁর কাছে প্রস্তাব আসে বৃক্ষচ্ছেদনকারীদের হয়ে কাজ করার জন্য। আমাজনের গভীর অরণ্যে প্রবেশকারী রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য একটি অনৈতিক বুথ খুলতে বলা হয় তাঁকে। তার জন্য মোটা টাকা ঘুষেরও প্রস্তাব দেন তাঁরা। বলাই বাহুল্য সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ওসভালিন্দা।

তারপর থেকেই তাঁদের রোষানলে পড়েন এই ব্রাজিলিয়ান পরিবেশকর্মী। প্রতিদিনই হুমকি আসতে থাকে প্রাণহানির। এমনকি কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে হুঁশিয়ারিও দিয়ে যায় ভাড়াটে গুণ্ডারা। বাড়ির পিছনের জমিতে খনন করে রেখে যায় দু-দুটি কবর— তাঁর এবং তাঁর স্বামীর জন্য। তাছাড়াও বাইক নিয়ে প্রতিদিন সকালেই তাঁর বাড়িতে হাজির হত দুষ্কৃতীরা।

আরও পড়ুন
ঠিক যেন মহাজাগতিক রশ্মির বিকিরণ, বিস্ময় জাগাচ্ছে আমাজনের বিলুপ্ত গ্রামের মানচিত্র

অত্যাচারের পরিমাণ এতই বেড়ে গিয়েছিল যে ২০১৮ সালে বাধ্য হয়েই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান ওসভালিন্দা। বছর দুয়েক সেখানে কাটালেও আমাজন ছেড়ে থাকার হতাশা গ্রাস করে তাঁকে। কাজেই মাস চারেক আগে গ্রামের বাড়িতেই ফিরে এসেছেন তিনি। সবকিছু উপেক্ষা করেই আবার শুরু করেছেন পরিবেশরক্ষার কর্মসূচি। তবে পাল্টায়নি পরিস্থিতি। গ্রামে এসে তিনি জানতে পারেন বৃক্ষচ্ছেদনকারীরা তাঁর মাথার দাম ঠিক করেছে ১৭ হাজার মার্কিন ডলার। তবে নিজের প্রাণ ভবিতব্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন ওসভালিন্দা। শুধুমাত্র গাছেদের ভালোবেসেই। 

এমন পরিবেশকর্মীর জন্যই তো যোগ্য এই পুরস্কার। ওসভালিন্দার এই কাজের জন্য অভিভূত সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টেফেন লোভফেনও। পুরস্কেরের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান তিনি। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারের হাই কমিশনার মাইকেল ব্যাচেলেটও শুভেচ্ছা পাঠান তাঁকে। পরবর্তীকালে সমস্ত প্রশাসনিক সাহায্যের জন্যেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এখন দেখার তাঁর এই পুরস্কারপ্রাপ্তি সত্যিই কতটা বদলে দিতে পারে পরিস্থিতিকে...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বৃক্ষচ্ছেদন নয়, অন্যান্য বনজ দ্রব্যেই বাড়বে আয়; আদিবাসী উন্নয়নে নয়া পন্থা ত্রিপুরার

More From Author See More