সঙ্গীরা মারা গিয়েছেন আগেই, আমাজনের গভীরে বাঁচার লড়াই ‘পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষে’র

সাল ২০২০। একটা বছর, একটা মহামারী আমাদের নতুন করে বুঝিয়ে দিয়েছে একাকিত্বের মানে। বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রিয়জনদের থেকে দূরত্বে থাকা কতটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু যদি এভাবেই আজীবন দিনযাপন করতে বলা হয়? তাও ঘরের মধ্যে সেলফ-কোয়ারেন্টাইন নয়, বরং নির্জন দ্বীপ কিংবা গহীন অরণ্যে বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না রেখে? রবিনসন ক্রুসোর মতো টিকে থাকতে পারবেন তো? 

এমন পরিস্থিতির কথা বলায় হয়তো ভাবছেন, এ আর বাস্তবে সম্ভব কোথায়। শুধুমাত্র গল্প-উপন্যাসেই দেখা মেলে এমন চরিত্রদের। লেখকের কল্পনাতেই গড়ে ওঠে এমন প্রেক্ষাপট। কিন্তু, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আমাজনের চিরহরিৎ অরণ্যেই রয়েছেন এমনই এক ব্যক্তি। যার নেই কোনো পরিবার। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো মানুষের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই তাঁর। নেই সামান্যতম কথার আদানপ্রদানও। এমন বৈশিষ্টের জন্যই তিনি খ্যাত ‘দ্য লোনলিয়েস্ট ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসাবে। যদিও আরও একটি পরিচয় রয়েছে তাঁর। ‘দ্য ম্যান অফ হোলস’।

১৯৯৬ সাল। পশ্চিম ব্রাজিলের রাজ্য রোনডানিয়ায় হঠাৎই গুজব ছড়িয়েছিল আমাজন অরণ্যে বসবাস করেন এমনই একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। এক আদিম উপজাতি গোষ্ঠীর সদস্য তিনি। তবে গোষ্ঠী বলা ভুল হবে। কারণ তাঁর উপজাতির আর দ্বিতীয় কোনো মানুষের তখন অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে।

এই ব্যক্তির কথা রীতিমত চাউর হয়ে যেতে সরকারি আধিকারীকেরা বিষয়টি পরীক্ষা করতে পৌঁছান আমাজনের ওই অংশে। না, গুজব যে একেবারে মিথ্যে নয়, তা গিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা। প্রাথমিকভাবে দেখতে পেয়েছিলেন মাটিতে খুঁড়ে রাখা বেশ কয়েকটি গর্ত। গভীরতা আনুমানিক ছ’ফুট। তবে আরও খানিক অনুসন্ধান চালাতে গিয়েই বিপত্তি বাঁধে। সটান ভারী কাঠের তীর এসে বিঁধে যায় এক আধিকারিকের বুকে। প্রথমবারের জন্য সাক্ষাৎ পাওয়া যায় ‘পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম ব্যক্তি’-র। তবে পূর্বপরিচিত আদিম জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কোনো মিল নেই তাঁর। সম্পূর্ণ অজানা তাঁর আচার-আচরণ, সংস্কৃতি। বহিরাগতদের অনুষঙ্গ যে তিনি পছন্দ করছেন না তা-ই শরনিক্ষেপের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন তিনি।

আরও পড়ুন
আমাজন বাঁচাতে মরণপণ লড়াই, গোল্ডম্যান পুরস্কার জিতলেন উপজাতি মহিলা

সারা পৃথিবীতে বর্তমানে এমন ১০০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সন্ধান মেলে, যাঁরা বাকি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অন্যকোনো জনগোষ্ঠী কিংবা সভ্যতার মানুষদের উপস্থিতি পছন্দ করেন না তাঁরা। হয়ে ওঠেন হিংস্র। এই সব উপজাতির প্রায় অর্ধেকের বেশি জনজাতির বসবাস আমাজন রেনফরেস্টে। ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সেন্টিনালরাও এই ধরণের ‘আনকন্ট্যাক্টেড ট্রাইব’।

তবে সত্যিই কি তিনি একা? এই উপজাতির কেবলমাত্র একটি মানুষ নিয়েই গঠিত? তাও তাঁর বয়স আনুমানিক ৩০-এর কোঠায়? কীভাবে সম্ভব এই জনজাতির বাকি সদস্যদের মুছে যাওয়া? উত্তর খুঁজতেই একটি বিশেষজ্ঞ দল সন্ধান চালায় আমাজনের অরণ্যে। তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সরকারি কর্মকর্তারা নিকটবর্তী অঞ্চলেই সন্ধান পান সম্পূর্ণ একটি কলোনির। একদম একই পদ্ধতিতে তৈরি গর্ত করে বানানো ১৪টি আবাসস্থল। তবে তা জনমানবশূন্য। ধ্বংসস্তূপ। দেখে বোঝা যায় বুলডোজার থেঁতলে দিয়েছে এই মানুষগুলোর ঘর-বাড়ি। আর মানুষগুলো? 

আরও পড়ুন
৫০০ থেকে কমে ৪৭! বনভূমির সঙ্গে হারাতে চলেছে আমাজনের ভাষাও

বহির্বিশ্বের সৌজন্যই হয়তো প্রাণ গিয়েছিল তাঁদের। অনেক তল্লাসি করেও চিহ্ন পাওয়া যায়নি তাঁদের। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল অনৈতিক বননিধনকারী, গবাধি পশুর চারণভূমি বা বসতিস্থাপনকারী ‘সভ্য’ মানুষদের হাতেই মুছে গেছে একটি গোটা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব।

তবে তার পরেও চলেছে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা। প্রতিবারই শরক্ষেপণের সঙ্গে বিভিন্ন শব্দ করেও তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বিরক্ত না করতে। কিন্তু সে ভাষার একমাত্র বক্তাই যে তিনি। ফলে কোনোভাবেই পাঠোদ্ধার করা যায়নি তাঁর ভাবভঙ্গির। ব্রাজিল সরকার এর পরই ৩১ বর্গমাইল অরণ্যাঞ্চল বরাদ্দ করেন ওই ব্যক্তির জন্য। নিষিদ্ধ করে ওই অংশে উন্নয়ন, বনভূমি নিধন, পশুপালন এবং ঝুম চাষ। পরে সীমাক্ষেত্র আরও বাড়ানো হয় ১১.৪ বর্গমাইল।

আরও পড়ুন
শুধুমাত্র জুলাইতেই ধ্বংস হয়েছে সাও-পাওলোর থেকেও বৃহৎ বনভূমি, সংকটে আমাজন

কিন্তু এত কিছুর পরও নিরাপত্তা পাননি তিনি। ২০০৯ সাল নাগাদ বন্দুক হামলার শিকার হন পৃথিবীর অজানা জনগোষ্ঠীর শেষ মানুষটিও। তবে আহত হয়েও ভাগ্যবশত পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হন তিনি। এই ঘটনার পর নিরাপত্তা জোরালো করতে পদক্ষেপ নেয় ব্রাজিল প্রশাসন। এই ধরণের ‘আনকন্ট্যাক্টেড’ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগস্থাপনে পারদর্শীদের নিয়ে তৈরি করা হয় একটি কমিটি। রুটিন মেনে তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন ‘গর্তমানব’-এর দৈনিক যাপন। লক্ষ্য করেন তিনি নিজেই চাষাবাদ করেন অরণ্যে। রাতের অন্ধকারে ভুট্টা, ম্যানিওক, পাওপাও প্রভৃতি শস্যের পরিচর্যা করেন তিনি। 

সেই সূত্র ধরেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বিশেষজ্ঞরা। উত্যক্ত না করেই উপহার হিসাবে তাঁর কাছে রেখে মাঝেমধ্যেই তাঁরা রেখে আসতেন শস্যের বীজ, চাষাবাদের সরঞ্জাম। অনেকটা কাজ হয় তাতে। গড়ে ওঠে বিশ্বস্ততার একটি সম্পর্ক। 

সম্পর্কস্থাপনের পরেই নিশ্চিত করা গিয়েছিল তাঁর সুরক্ষা। মোতায়েন করা হয়েছিল ওই অঞ্চলের আশেপাশে সশস্ত্র প্রহরীদের। ২০০৯ সালের পর আধিকারিকরা বহুবার মুখোমুখি হয়েছেন গর্তমানবের। না, কোনোরকম আক্রমণ করেননি তিনি। তবে উচ্ছ্বসিতও যে হয়েছেন, তেমনটা নয়। তবে শিকারের জন্য খুঁড়ে রাখা গর্তের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন সুরক্ষাকর্মীদের। শরক্ষেপণে বুঝিয়ে দিয়েছে বন্যপ্রাণীদের ধরার জন্য তাঁর পেতে রাখা ফাঁদে পা দিলে বিপদে পড়তে পারেন আধিকারিকরা। ২০১৮ সালে প্রকাশ্যে আসে তাঁর একটি ভিডিও-ও। দেখা যায় ভারী কোনো অস্ত্র দিয়ে জঙ্গলের কাঠ কাটছেন তিনি। বয়স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-এর কোঠায়।

এই গল্প যেন অনেকটা রূপকথার মতোই। অন্যদের উপস্থিতি অপছন্দ করা সত্ত্বেও তাঁর এই আচরণ যেন মনে করিয়ে দেয় মানবিকতার কথাই। সেইসঙ্গে কাঠগড়ায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় মানুষকে। ‘আদিবাসী’, ‘অসভ্য’ ইত্যাদি শব্দবন্ধে তাঁদের অভিহিত করা মানবসভ্যতা সত্যিই কি ‘সভ্য’ হয়ে উঠতে পেরেছে এতটুকু? এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসে বারবার। 

আরও কিছু বছর নয় এভাবেই যাবে। তারপর? অজানা এক জনজাতির সংস্কৃতি, ভাষা, যাপনচিত্র অজানা থেকেই হারিয়ে যাবে চিরতরে। চাইলেও সেই দায় এড়াতে পারব তো আমরা? 

Powered by Froala Editor

More From Author See More