দুষ্প্রাপ্য বই থেকে প্রাচীন পদক – দক্ষিণ কলকাতার এই দোকান যেন আদ্যিকালের সিন্দুক

‘সিমা আর্ট' গ্যালারির কোনো দুষ্প্রাপ্য ক্যাটালগ?
হেমেন মজুমদারের নাম না জানা ছবির প্রিন্ট?
বিকাশ ভট্টাচার্য কিম্বা ‘চিত্তপ্রসাদ সংগ্রহ'? 

ফরাসি ইম্প্রেশনিস্টদের নিয়ে বহু পুরোনো কোনো সংকলন?

সবকিছুই মিলবে নাকের ডগায়। গড়িয়াহাট বাজারের ভেতরে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। অমূল্য রত্নসম্ভার নিয়ে আলো করে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট দোকানটি। নাম ‘অহণায়ন’। দোকানের উল্টোদিকেই বেঞ্চি পাতা। তার পাশে বই-এর রাশি। বেঞ্চিতে বসে বেশ কয়েকজন। জমে উঠেছে আড্ডা। এই আড্ডার বিষয়ও বই। সঞ্চালনায় ‘অহণায়নে’র কর্ণধার প্রবীর চট্টোপাধ্যায়। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই গড়িয়াহাট চত্ত্বরেই তাঁর বই-এর ব্যবসা। এই দোকানে নির্বিঘ্নে বসে পড়া যাবে বই। কোনো বইয়ের সন্ধান না পাওয়া গেলে, প্রবীরবাবুই বলে দেবেন তার ঠিকানা...

১৯৮৩ সালে গড়িয়াহাট বুলেভার্ড-এর নীচে একটা ছোট্ট গুমটি দিয়ে যাত্রা শুরু অহণায়নের। অল্প কিছু পাঠ্যপুস্তক দিয়েই ব্যবসা শুরু। তবে পাঠকের চাহিদা বেড়ে ওঠে। ক্রমে পাঠ্যপুস্তকের জায়গায় ঠাঁই পায় উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা। 

‘তখনও বই চিনতে শিখিনি আমি। তবে আমার বন্ধুভাগ্য ভালো বলতেই হবে। কয়েকজন পাঠককে দেখেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পড়ছেন। অনেকেই বাড়ি যাবার ভাড়াটি পর্যন্ত খরচ করেছেন বই-এর পেছনে। এমন বহু একদা ‘খদ্দের’ হয়ে উঠেছেন আত্মীয়। শুধু বই কেনা নয়, অনেকেই বইয়ের সন্ধান নিয়ে এসেছেন। বই বাছাই-এ সাহায্য করেছেন। অহণায়ন আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে এঁদেরই জন্য…’ বলছিলেন প্রবীরবাবু।

আরও পড়ুন
কলকাতা বইমেলা হচ্ছেই, আশাবাদী গিল্ড; তারিখ নিয়ে সংশয় কাটল না বৈঠকেও

২০০৬ সাল থেকে চিত্রকলা বিষয়ক বই রাখতে শুরু করলেন তিনি। নেশা লেগে গিয়েছিল। বদলাচ্ছিল চোখ। ধীরে ধীরে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের জহুরী হয়ে উঠছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন, খবর পেলেই। ট্রেনে বাসে ঝুলে, অমূল্য রতন ঝোলায় ভরে আনছেন। কোনো লাইব্রেরি, ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিলামে উঠলেই পৌঁছে যাবেন। তারপর…

তবে অনেক বইই প্রাণে ধরে বিক্রি করতে পারেননি তিনি। এইভাবে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে প্রায় ২,৫০০ দুষ্প্রাপ্য পুস্তক। 

“খেতে না পেলেও এগুলো বেচব না।”

আরও পড়ুন
পেশায় চা বিক্রেতা, লিখেছেন ২৫টি বই; অনুপ্রেরণার অন্য নাম লক্ষ্মণ রাও

তবে বই ছাড়াও তাঁর কাছে আছে দু'টি আশ্চর্য জিনিস। তার একটি হল ‘হিন্দুমেলা'র পদক। হ্যাঁ, সেই ‘ন্যাশনাল নবগোপাল মিত্তির' এবং রাজনারায়ণ বসুদের উদ্যোগ-- ঐতিহাসিক ‘হিন্দু-মেলার' কথাই বলছি। ১৮৭৯ সালে সূচিশিল্পের জন্য চারজন নারীকে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল হয় হিন্দুমেলায়। সেই চারজনের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদি সৌদামিনী। তবে প্রবীরবাবুর কাছে রয়েছে গৌরীবালা দেবীর পদক। তিনিও ছিলেন চার বিজয়িনীদেরই একজন। 

একটি বর্মী-বাক্সও সংগ্রহে রয়েছে তাঁর। জনৈক মুখার্জি পরিবারের থেকে পেয়েছিলেন সেই অপূর্ব কাজ করা ঝাঁপি। এছাড়াও অষ্টাদশ-উনিশ শতকের বহু বই তিনি রেখে দিয়েছেন সযত্নে। বিভিন্ন গবেষণার কাজে তাঁর এই বইয়ের ভাঁড়ার এক লাইব্রেরিস্বরূপ। প্রামাণ্য গ্রন্থের ছবি চেয়ে ফোন আসে দেশ বিদেশ থেকে। ছবি তুলে পাঠিয়ে দেন প্রবীরবাবু।

আরও পড়ুন
বন্ধ হতে চলেছে সিমলার প্রাচীন বইবিপণী ‘মারিয়া ব্রাদার্স’, থমকে দাঁড়াল ইতিহাসও

‘কোনো পাঠক বই সম্পর্কে দু'টি প্রশ্ন করলে, তার সদর্থক উত্তর যদি না দিতে পারি, তবে আর বইয়ের ব্যবসায় আসা কেন? আমাদের তো কর্তব্য পাঠকের কৌতূহল মেটানো। তাদের খিদেটা বাড়িয়ে দেওয়া। ধরা যাক, আমার কাছে কোনো একটি বই নেই... কিন্তু তাহলেই পাঠকের প্রতি আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমি চেষ্টা করি, যেকোনো মূল্যে বইটি সংগ্রহ করার। আমার সাধ্যের বাইরে হলে পাঠককে অন্তত সঠিক হদিশটি বাতলে দেবার। এমনও হয়েছে, পাঠকের সঙ্গে আমিও বেরিয়ে পড়েছি। আসলে বইয়ের সঙ্গে ঘর করতে করতে কখন যে অনুরাগীতে পরিণত হয়ে গেছি, বুঝিনি।’

কথা বলতে বলতে লেবু চা চলে এল আরও এক কাপ। মাস্কপরা দু'জন পাঠককে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন প্রবীরবাবু। তাঁরা গণেশ পাইনের কোনো একটি দুষ্প্রাপ্য ক্যাটালগের খোঁজে এসেছেন, সেই রাজারহাট থেকে। লকডাউনের বাজারে অহণায়ন খুলছে সপ্তাহে তিনদিন। মঙ্গল, শুক্র এবং শনি। জমে উঠছে তর্ক…

খাস দক্ষিণ কলকাতার বুকে একটুকরো সত্তর দশকের বই-পাড়া যে খুঁজে পেয়ে যাব, ভাবতে পারিনি...

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: প্রবীর চট্টোপাধ্যায়, অহণায়ন)

Powered by Froala Editor