ভীমবেটকার গুহাগুলি ছিল জলের তলায়, ধারণা বিজ্ঞানীদের

চতুর্থ পর্ব

ভীমবেটকায় ৭০০টিরও বেশি শৈলাশ্রয় পাওয়া গেছে। তার মধ্যে প্রায় ৫০০টিতে ছবি আঁকা আছে। সাধারণ দর্শনার্থীদের পক্ষে সবগুলো দেখা সম্ভব নয় এবং প্রয়োজনও নেই। অনেকগুলিতেই প্রায় একই রকম ছবি। এদের মধ্যে কয়েকটি বিশেষ শৈলাশ্রয়ের বর্ণনা করলেই ভীমবেটকার বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারা যায়।

তৃতীয় পর্ব
ট্রেনে যেতে যেতে চোখে পড়ল টিলা, ভীমবেটকার আবিষ্কার এভাবেই

একটি শৈলাশ্রয়ের দেয়ালের ছবিগুলোর সমষ্টিকে ‘শৈল চিড়িয়াখানা’ বা Zoo Rock বলা হয়ে থাকে। এর কারণ এখানে হাতি, সম্বর ও চিতল হরিণ আর বাইসনের ছবি আছে। ময়ূর, সাপ, হরিণ আর সূর্যের ছবিও পাওয়া যায় আরেকটি শৈলাশ্রয়ে। আর একটিতে দুটি দাঁতাল হাতির ছবি। আদিম মানবের খাদ্য সংগ্রহের জন্য শিকারের অপরূপ বর্ণনা একটি শৈলাশ্রয়ের বিষয় হয়েছে। এটাতে তির-ধনুক ও ঢাল-তরোয়াল নিয়ে শিকারের ছবি স্থান পেয়েছে। শিকার যে অনেক সময়ই বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তাও আমরা আদি মানবের অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষ্য করতে পারি একটি শৈলাশ্রয়ের চিত্রণ থেকে। দুই শিকারি তাদের এক সহ-শিকারির বাইসনের তাড়ার মুখে পড়ায় কি রকম ভাবে অসহায় দর্শকে পরিণত হতে হয়েছে, তার বর্ণনা দেখে বিস্ময়াভূত হতে হয়। তীরন্দাজ সহ অশ্বারোহী মানুষের চিত্রণ দেখতে পাওয়া যায় আরো একটি শৈলাশ্রয়ে। যেহেতু অশ্বের আগমন ভারতীয় উপমহাদেশে খুব একটা প্রাচীন নয়, তাই বোঝা যায় যে কিছু ছবি প্রাগৈতিহাসিক যুগের নয়। এর সঙ্গে এও ধারণা করা যায় যে, ভীমবেটকায় আঁকা ছবিগুলো ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন যুগে আঁকা হয়েছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ভীমবেটকার এবং সামগ্রিক রূপে প্রাগৈতিহাসিক শৈল-ছবির ক্রম বিকাশ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন এসে পড়ে। তবে এই আলোচনা আপাতত মুলতুবি রাখা যাক বরং এখানকার শৈল-ছবির সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দেওয়া যাক।

অনেক বৈজ্ঞানিক মনে করেন যে ভীমবেটকায় এই শৈলাশ্রয়গুলি কোনোকালে সাবেকি গুহা রূপে জলের তলায় ছিল। কালক্রমে জলের স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এগুলো ভূস্তরের উপরে চলে এসেছে। এই ধারণার কারণ হল যে এই শৈলাশ্রয়গুলোর পাথরের গা অতি মসৃণ এবং বিভিন্ন রং ও চেহারার। এই ছবিগুলির মাধ্যমে গুহামানবদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার পাশাপাশি মানব সভ্যতার পর্যায়ক্রমের সম্পর্কেও অনেক কিছুর সাক্ষ্যপ্রমাণ এইগুলো থেকে পাওয়া যায়। একই জায়গায় বিভিন্ন কালের ছবি পাওয়া যায়। এর থেকে বিচার করা যায় যে এই শৈলাশ্রয়গুলো বিভিন্ন সময়কালের মানব বা মানবগোষ্ঠী ব্যবহার করেছিলেন।

Zoo Rock-এর কথা আগেই বলা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু শৈলাশ্রয়ে অন্যান্য পশুদের ছবিও পাওয়া যায়, যেমন সিংহ, বাঘ, শুয়োর, কুকুর, গিরগিটি, কুমির ইত্যাদি। একটি শৈলাশ্রয়ে দুই অ্যান্টিলোপের মধ্যে লড়ায়ের ছবি খুবই চিত্তাকর্ষক।  এই গুহাচিত্রগুলোয় প্রধানত লাল ও সাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সবুজ ও হলদের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। চিত্রণগুলোর রং এখনও বেশ উজ্জ্বল রয়েছে। প্রকৃতিতে পাওয়া বস্তু, যেমন বিভিন্ন গাছপালা, ফুল, পাতা, মাটি এবং পশুচর্বি থেকে রং তৈরি করে গাছের ছাল থেকে তৈরি তুলির সাহায্যে ছবিগুলো আঁকা হয়েছে। তাছাড়া শৈলাশ্রয়ের ভিতরে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না সেই জায়গাগুলোয় ছবি আঁকার জন্যে পছন্দ করা হয়েছে উজ্জ্বল রঙ সেই কারণে ছবিগুলিও স্থায়ী রয়েছে। আরও এক কারণ এই স্থায়িত্ব রক্ষার সহায়ক হয়েছে। তা হল, এই জায়গার পাথরে রাসায়নিক পদার্থ জৈব রঙে উপস্থিত পদার্থকে জারণ করে স্থায়ী করে দিয়েছে।

(ক্রমশ)

ছবি ঋণ - wondermondo.com

More From Author See More