তিনহাজার বছরের প্রাচীন রাঢ়বাংলার সভ্যতা স্পর্শ পেয়েছে মহাবীর ও বুদ্ধেরও

ভারতবর্ষের মানুষ রাঢ়া বা রাঢ়দেশের কথা প্রথম জানতে পারে জৈন গ্রন্থ 'আচারঙ্গ সূত্র' থেকে। খ্রিষ্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতকে একবার মহাবীর জৈন এই রাঢ়দেশে এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের জন্য। গহন, দুর্গম পথে এসে তিনি নিষ্ঠুর, রূঢ়-প্রকৃতির মানুষগোষ্ঠীর দ্বারা লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। সম্প্রতি গবেষকেরা দেখেছেন যে, এই রূঢ়-প্রকৃতি দেশ কখনওই রাঢ়দেশীয় বর্ধমান নয়, বনাঞ্চলঘেরা এই দেশ ছোটোনাগপুর মালভূমি লাগোয়া কোনো স্থান বা বীরভূমের সাঁওতাল পরগনার পাশে থাকা অরণ্য-অধ্যুষিত পার্বত্যভূমি হতে পারে।

গ্রন্থে রাঢ়দেশের দুটি ভাগের কথা বলা আছে - একটি ব্রহ্মভূমি অন্যটি হল সুহ্মভূমি। ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাসের আদিপর্বে এই ভাগদুটির নাম লেখা – বজ্জ বা বজ্রভূমি অথবা ব্রহ্মভূমি এবং সুরভ বা সুহ্মভূমি। যদিও এই ভাগ দুটির নামগুলি পরবর্তীতে আর পাওয়া যায় না, তার বদলে উত্তর রাঢ়দেশ আর দক্ষিণ রাঢ়দেশ বলেই বেশি খ্যাতি লাভ করেছে। অজয় নদের উত্তর দিক থেকে ভাগীরথী পর্যন্ত উত্তর রাঢ়দেশ এবং অজয় নদের দক্ষিণ দিক থেকে দামোদর পেরিয়ে অবস্থান করা বিস্তৃত অঞ্চলকে দক্ষিণ রাঢ়দেশ বলা হয়।

রাঢ়দেশীয় বিবরণ পাওয়া যায় চতুর্থ শতাব্দীর পালিভাষায় লেখা সিংহলী বৌদ্ধগ্রন্থ দীপবংশতে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মহাবংশ বৌদ্ধগ্রন্থের কিছু কিছু অংশে রাঢ়দেশের কথা পাওয়া যায়। এর একটা কারণ হতে পারে রাঢ়ের রাজপুত্র বিজয় সিংহের সিংহল বিজয়, যার রাজধানী ছিল সিংহপুর, যেটি বর্তমানে হুগলি জেলায় বলে ধরা হয়। এরপর অনেক অনেককাল রাঢ়দেশের বিবরণ পাওয়া যায়নি কোনো গ্রন্থে বা অভিলেখের খোদিত অক্ষরে।

একাদশ শতকের প্রথমদিকেই আবার রাঢ়দেশের বিবরণ পাওয়া যায় প্রথম রাজেন্দ্র চোলের তিরুমালাই অভিলেখে। এর একটি প্রধান কারণ হল, চোলদের প্রথম শক্তিশালী রাজা হিসাবে প্রথম রাজেন্দ্র চোল তৎকালীন কলিঙ্গরাজ মধুকুমার্নবকে হারিয়ে কলিঙ্গ পার হয়ে উত্তর রাঢ়-অংশের গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত জয়লাভ করেন। নিজেকে গঙ্গাইকোন্ডচোল বলে ঘোষণা করেন এবং এই রাঢ়দেশের উপর দিয়ে তথা তৎকালীন বাংলা পেরিয়ে  সংগম বিজয়তুঙ্গকে চিনদেশে বাণিজ্য ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের শুভেচ্ছা দূত হিসাবে পাঠান।

মধ্যবর্তী কয়েক শত বছর রাঢ়ের কথা তেমন পাওয়া যায় না। অনুমান, তৎকালীন শক্তিশালী রাজ্য গৌড়ের সঙ্গে রাঢ়দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তিরুমালাই অভিলেখ অনুযায়ী রাঢ় দুটি অংশের নাম উত্তর লাড়াম ও তক্কণ লাড়ম অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়। উত্তর অংশের রাজা প্রথম মহীপাল এবং দক্ষিণ অংশের রাজা রণশূর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই অর্থে রাঢ়দেশ দুটি স্বতন্ত্র রাজ্য! 

দীনেশচন্দ্র সরকারের লেখা বই ‘পাল-পূর্ব সেন যুগের বংশানুচরিত’ থেকে আমরা পাই ৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের উৎকীর্ণ পরমা মুঞ্জের গাঁওরি শাসনে দক্ষিণ রাঢ়ের কথা এবং ত্রয়োদশ শতকের মলকাপুর শিলালেখে গৌড়ের অন্তর্গত দক্ষিণ রাঢ়দেশের কথা। এই সময়ের সাহিত্যের উপাদান হিসাবে পাওয়া যায় একাদশ-দ্বাদশ শতকে রচিত কৃষ্ণমিশ্রের প্রবোধ চন্দ্রোদয় নাটকে রাঢ়দেশীয় অঞ্চলের কথা এবং তার প্রধান নগর রাঢ়াপুরীর কথা। তবে শুধু দক্ষিণ রাঢ় নয়, উত্তর রাঢ়ের কথাও পাই আমরা নবম শতকের গঙ্গারাজ দেবেন্দ্র বর্মনের একটি লিপির মধ্যে। পরে রাজা ভোজবর্মার বেলাব লিপিতেও সন্ধান মেলে উত্তর রাঢ়ের বিস্তৃত অঞ্চলের। পরে যোড়শ শতকে রচিত দিগ্বিজয় প্রকাশ গ্রন্থে দামোদর নদ ও সেই অঞ্চলের কথা আছে। সেনযুগে বল্লালসেনের নৈহাটি তাম্রশাসন এবং লক্ষ্মণসেনের শক্তিপুর তাম্রশাসনেও রাঢ়দেশের কথা আছে, তবে সেই সব অঞ্চল বেশিরভাগই মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। বর্তমান বাংলা তখন চারটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল বরেন্দ্র, রাঢ়, বাগড়ি ও বঙ্গ।

হিউয়েন সাং এসেছিলেন পূর্ব ভারতের ভ্রমণে, তিনি কর্ণসুবর্ণ এসেছিলেন অথচ তাঁর বিবরণীতে রাঢ়দেশের কথার উল্লেখ নেই। তার পরিবর্তে আছে কজঙ্গল স্থানের কথা। কজঙ্গল রাঢ়দেশের উত্তরাংশে বর্তমানে রাজমহল পাহাড় ও পাহাড়তলি অঞ্চলকে ধরে নেওয়া হয়। ডঃ নীহার রঞ্জন রায় তাই কজঙ্গলকে রাঢ়ের উত্তরাংশ বলে নিদান দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলা যায় চোদ্দশ-পনেরো শতকে রচিত ভবিষ্যতপুরাণের কথা, সেখানে ব্রহ্মখণ্ড অধ্যায়ে ভাগীরথীর পশ্চিমদিকে রাঢ়িখণ্ড জঙ্গল নামক অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে।

এখন রাঢ়দেশের তৎকালীন সীমানা নির্ণয় করলে দাঁড়াবে উত্তরে রাজমহল পাহাড়িয়া অংশের কজঙ্গল, দক্ষিণপূর্বে বঙ্গ। যার শুরু কাটোয়া মহকুমার ও তার উত্তরাংশ থেকে দামোদর উৎস ধরে বীরভূমের পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত। এখন ডঃ নীহার রঞ্জন রায়ের মতানুসারে যদি আমরা কজঙ্গলকেও রাঢ়ে ধরি, তাহলে বলা যায় History & culture of indian people গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী কজঙ্গল গৌতম বুদ্ধের স্পর্শধন্য কারণ বুদ্ধদেব সশিষ্য কজঙ্গল ভ্রমণ করেছিলেন। আবার সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে কজঙ্গলের রাজা নরসিংহ বা নরসিংহার্জুনের কথা আছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ শতকের মাঝে লেখা বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা ছয়টি বৃহৎ জনপদ গৌড়, পৌণ্ড্র, সমতট, তাম্রলিপ্তের সাথে রাঢ়দেশীয় বর্ধমানেরও উল্লেখ আছে। ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে জাও দ্য ব্যারোসের মানচিত্রে রাঢ়ের অবস্থান সুন্দরভাবে অঙ্কিত আছে। মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী রাজা কর্ণ বঙ্গ, কলিঙ্গ সহ পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলি জয় করেন, ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন তিনি রাঢ়দেশকেও তার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

১৯৬২-৬৩ সালে পূর্ব বর্ধমানে নতুনহাটের পাণ্ডুরাজার ঢিপিতে খননকার্য চালিয়ে দেখা যায়, দু-তিন হাজার বছর আগেও রাঢ়দেশে উন্নত জাতির বাস ছিল। এরা আলপাইন জাতির শ্রেণিভুক্ত বলে ধরা হয়। ভাগীরথী ও তার উপনদীগুলির ক্রমে-ক্রমে দিক ও গতি পরিবর্তনের জন্য রাঢ়দেশীয় মানুষের ভাগ্য বারবার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং একইভাবে আজও তা বয়ে চলেছে।

More From Author See More