এই গুহাগুলির সামনেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহাভারতের ভীম

দ্বিতীয় পর্ব

এই গুহাগুলির কাছে পৌঁছোলে মনে হয়, একটা পাহাড় যেন বিশাল কচ্ছপের মতো আকৃতি নিয়ে মহাস্থবির জাতকের মত আবহমান কাল ধরে পাহাড়ের মাথায় বসে সব কিছু দেখে চলেছে। সৃষ্টি হয়েছে মাশরুমের মত একখানা দৈত্যাকার পাহাড়। এমন কত যে আকৃতি, তা দেখে শেষ করা যায় না।

প্রথম পর্ব
ছবি আঁকলে সহজ হবে শিকার, ভাবত ভীমবেটকার শিল্পীরা

কিন্তু সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্য হল গুহাচিত্র। বিশাল একটা প্রাকৃতিক আর্ট গ্যালারি, যার ভেতরে আপন খেয়ালে বহু যুগ ধরে বহু মানুষ এঁকে গেছে একপাল পশুর রেখাচিত্র। কোনো ছবিতে ঘোড়সওয়ার নিয়ে চলেছে একপাল যোদ্ধা। কোনোটিতে কেউ এঁকে রেখেছে ১৯টি মোষের প্রতিকৃতি। কোথাও আবার হাতির পাল কিম্বা ছুটন্ত হরিণের সার। কেউ এঁকে রেখে গেছে ঘোড়ার পিঠে বাজনদার এবং নৃত্যরত মানুষ। কোনটিতে রাখাল বালক একপাল গবাদি পশুকে সামলাচ্ছে। এইভাবে জল, আর হাওয়ার দাপটে যুগ যুগ ধরে ভীমবেটকার গুহাগুলি বাঁচিয়ে রেখেছে এই দুষ্প্রাপ্য গুহাচিত্রগুলিকে।

কথিত আছে, পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসের সময় এখানে বাস করেছিলেন। আর ভীমবেটকার সংলগ্ন লাক্ষাজুহার জঙ্গলেই দুর্যোধন পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চক্রান্তে লাক্ষা নির্মিত গৃহ সকৌশলে নির্মাণ করেন। মধ্যপ্রদেশের এই জায়গাটির নাম ভীমবেটকা কেন, তারও একটি নির্দিষ্ট গল্প আছে মহাভারতে। অজ্ঞাতবাসকালে এখানেই জরাসন্ধের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে। একটানা দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল ভীম বনাম জরাসন্ধের মল্লযুদ্ধ। শেষ দিন এখানেই জরাসন্ধকে পরাস্ত এবং হত্যা করেন ভীম। তারপর এই গুহাগুলির সামনের চাতালে একটি প্রস্তর খণ্ডে বসে বিশ্রাম নেন। সেখান থেকেই এর নাম ভীম কা পৈঠা বা ভীমবেটকা। ফলে ইতিহাস, পুরাণ, কথা উপকথা মিলিয়ে ভীমবেটকা এক রূপকথা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের বুকে।

অজ্ঞাতবাসকালে এখানেই জরাসন্ধের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে।

প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে আদিম মানবের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের শৈলাশ্রয়, যাকে বলে রক-শেলটার। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই ১ লক্ষ বছরকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন – নিম্নপ্যালিওলিথিক যুগ(১০০০০০ - ৪০০০০ বছর), মধ্য প্যালিওলিথিক যুগ(৪০০০০-২০০০০ বছর), উচ্চ প্যালিওলিথিক(২০০০০ - ১০০০০ বছর) এবং মেসোলিথিক যুগ(১০০০০-২৫০০ বছর)। মেসোলিথিক যুগ আমাদের পৌঁছে দেয় আমাদের অতি পরিচিত ঐতিহাসিক যুগে। ভারতবর্ষের মানবসভ্যতার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে আবিষ্কার করে জনসমক্ষে তুলে ধরেন ডাঃ ভি এস ওয়াকাঙ্কার।

আশ্চর্য এই যে, গুহাগুলি আবিষ্কৃত হয় মাত্র ৬১ বছর আগে।

প্রায় ৪০০টি চিত্রাঙ্কিত গুহা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভীমবেটকার গভীর জঙ্গলে। এবং এই শৈলাশ্রয়গুলিকে এর প্রাচীনত্ব এবং মানব ইতিহাসে এর তাত্পর্য স্বীকার করে ইউনেস্কো তাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আজও একবিংশ শতাব্দীতে বিশাল এই গুহার মধ্যে দাঁড়িয়ে এবং গুহার দেওয়ালের চিত্রগুলি দেখলে এক নিমেষে পৌঁছে যাওয়া যায় এক লক্ষ বছর আগে, যখন কোনো এক আদিম মানব শিকার করে ঘরে ফিরেছেন এবং আদম মানবী সেই শিকারের মাংস আগুনে ঝলসাচ্ছেন। সেই অবসরে গুহার দেওয়ালে মেলে সেই আদম মানব তুলে ধরছে তার সৃজনশীলতা। এই সুবিশাল গুহায় দাঁড়িয়ে গায়ে কাঁটা দেয় বৈকি। অথচ আশ্চর্য এই যে, গুহাগুলি আবিষ্কৃত হয় মাত্র ৬১ বছর আগে।

(ক্রমশ)

তৃতীয় পর্ব
ট্রেনে যেতে যেতে চোখে পড়ল টিলা; ভীমবেটকার আবিষ্কার এভাবেই

More From Author See More