ফাঁসি নয়, ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু চেয়েছিলেন ভগৎ সিং

বিশ শতকের প্রথম দিক। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে জ্বলে উঠেছে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। নরমপন্থী পথে নয়, সশস্ত্র সংগ্রামে জবাব দিতে হবে শাসক ইংরেজকে। বোমা-বন্দুকই বলবে শেষ কথা। বাংলায় তখন শহীদের সম্মান পেয়েছেন ক্ষুদিরাম বসু। রেশ ফুরোয়নি আলিপুর বোমা মামলার। ভারতের পশ্চিম প্রান্ত পাঞ্জাবেও চলছে সশস্ত্র আন্দোলনের আয়োজন। হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িকে বরণ করে নিয়েছেন অনেকে, বেড়ে চলেছে পুলিশি অত্যাচার। 

একটি ছ’বয়সের বালকের পক্ষে হয়তো এর মাহাত্ম্য বোঝা সম্ভব নয়। তবু, স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের সূত্রে ছিটকে আসে অনেক শব্দ। শিশুমনের মধ্যে জমা হতে থাকে সুপ্ত বাসনা। একদিন ছোটোখাটো সভা বসেছে সর্দার কিষণ সিং-এর বাড়িতে। এসেছেন জাতীয়তাবাদী নেতা মেহতা আনন্দকিশোর। হঠাৎ তিনি দেখলেন সেই বালকটি আপনমনে মাটি দিয়ে ঢিবি সাজাচ্ছে আর তার মধ্যে কাঠি গুঁজে দিচ্ছে। শিশুদের কাজকর্মের কতরকমই তো অর্থ হয়। তবু কৌতূহলী হয়ে খেলার মানে জিজ্ঞেস করলেন আনন্দকিশোর। মাথা তুলে শিশুটি জানাল, খেলা নয়, চলছে যুদ্ধ। এগুলো সব বন্দুক। কী হবে বন্দুক দিয়ে? বিদ্যুতের বেগে এসে পড়ল উত্তর, ইংরেজ তাড়াব, স্বাধীন হব। ছোটোবেলার সেই খেলা যে ভবিষ্যতের কর্ম হয়ে উঠবে, তার ইঙ্গিতই কি ছিল সেদিনের ঘটনায়? পরবর্তীতে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রাখতে দ্বিধা করেননি তিনি। মৃত্যু তাঁকে দিয়েছে অমরত্ব আর সমগ্র ভারতকে দিয়েছে লড়াই করার স্পর্ধা।

সেই শিশুর নাম যে ভগৎ সিং, সেটা আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়বে না নিশ্চয়ই। জন্ম ১৯০৭ সালে, পরিবারের সূত্রে ছোটো থেকেই পেয়েছিলেন বিপ্লবী নেতাদের সান্নিধ্য। কিশোর বয়সেই দেখেছিলেন অবধচাঁদ, বালমুকুন্দ, বিষ্ণুগণেশ পিংলে, বখশীশ সিং গিলওয়ালি প্রমুখদের ইংরেজ বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য ফাঁসিতে চড়তে। তবে, তাঁকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছিলেন কর্তার সিং সরোবা। মৃত্যুকালে যাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯। কর্তার সিং-কে মনে করতেন নিজের বীর বা আদর্শ। পকেটে রাখা থাকত তাঁর ছবি। 

১৯১৯ সালে ঘটল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। মৃত্যুর বিভীষিকা কৈশোরের সদ্য প্রস্ফুটিত চোখ দুটিতে ছিটিয়ে দিল রক্তের দাগ। কয়েক বছরের মধ্যেই গান্ধীজির উত্থানে একটা আশা জেগে উঠলেও, চৌরিচৌরার ঘটনার পর বুঝলেন স্বতন্ত্র পথ তৈরির কাজ শুরু করতে হবে ইতিমধ্যেই। দেশ তখন তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, জীবনের একমাত্র লক্ষ্য স্বাধীনতা। এদিকে বাড়িতে শুরু হল এক অন্য বিপত্তি। ঠাকুমা জেদ ধরে বসলেন ভগতের বিয়ে দিতে হবে। উঠেপড়ে লাগলেন কিষণ সিংও, বৃদ্ধা মায়ের আশা তিনি অপূর্ণ রাখতে চান না। ভগৎ সিং তখন বি.এ ক্লাসের ছাত্র। স্বাধীনতা সংগ্রামী পিতার থেকে এই বক্তব্য তিনি আশা করেননি। দু’পক্ষের কিছুদিন বাদানুবাদের পর, দিলেন চরমপত্র,
“তুমি কেবল দাদীর কথাই ভাবছ। কিন্তু আমাদের এই তেত্রিশ কোটি সন্তানের যিনি জননী, সেই দেশমাতার কথা তো ভাবছ না! তাঁর শৃঙ্খলমোচনের জন্যে যে আমাদের সবকিছু বিসর্জন দিতে হবে।”
সত্যিই সবকিছু বিসর্জন দিলেন। কলেজ ছেড়ে, লাহোর ছেড়ে চলে গেলেন। বন্ধুদের কাছে জানিয়ে গেলেন যে, পরাধীন ভারতে বিয়ে হবে একমাত্র মৃত্যুর সঙ্গে, বাসরশয্যা হবে শহীদের মিছিলে। ভবিষ্যৎ কি টের পেয়েছিলেন তিনি?

আরও পড়ুন
১৯ বছর বয়সে শহিদ, বিস্মৃতির অতলে ‘সিন্ধের ভগৎ সিং’

পিতার অন্ধস্নেহ শুধু বিবাহের ক্ষেত্রেই নয়, পরেও আরেকবার ক্ষুণ্ণ করেছিল ভগৎ সিংকে। ১৯৩০ সাল, তখন তিনি জেলবন্দি। আইন সভায় বোমা ফাটানোসহ অন্যান্য অপরাধে ভোগ করছেন কারাদণ্ড। অনশনে মৃত্যুবরণ করেছেন যতীন্দ্রনাথ দাস। বিশেষ ট্রাইবুন্যালে চলছে ভগৎ সিং-এর বিচার, ফাঁসি অনিবার্য। কিন্তু কোনো আইনজীবী নিয়োগ করেননি তিনি। কিষণ সিং আবেদন জানালেন ট্রাইবুন্যালের সদস্যদের কাছে। খবরটা কানে আসতেই পিতাকে দীর্ঘ চিঠি দিলেন তিনি। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো অভিপ্রায় তাঁর নেই, বিচারের ধারাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছেন তিনি। আর সেটাও একটা নির্দিষ্ট নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী। এই চিঠিটি ছাপা হয়েছিল ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায়। 

আরও পড়ুন
লাহোর থেকে ছদ্মবেশে কলকাতায়; বিধান সরণির এই বাড়িতেই লুকিয়ে ছিলেন ভগৎ সিং

১৯৩০-এর ৭ অক্টোবর শোনানো হল ফাঁসির আদেশ। নতুন কোনো খবর নয়। শুধু একটি আবেদন জানালেন পাঞ্জাব গভর্নরকে। চিঠিতে লিখলেন,
“...আপনার আদালতের রায় অনুসারে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম এবং সেই অর্থে এখন যুদ্ধবন্দী। সেইজন্য যুদ্ধবন্দীর উপযুক্ত ব্যবহারই আমরা প্রত্যাশা করি। অর্থাৎ ফাঁসিতে নয়, আমরা মরতে চাই ফায়ারিং স্কোয়াডে।”
মৃত্যু তো বহু পরিচিত বন্ধু, কতদিন যেন দেখা হয়নি তার সঙ্গে। সে আসছে আবার ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিতে। বাইরের দেশবাসীর জানা দরকার তাঁর কথা। একজন ভগৎ সিং মৃত্যুবরণ করলে, জন্ম নেবে কয়েক হাজার। অবশেষে ১৯৩১-এর ২৩ মার্চ ফাঁসি হয় ভগৎ সিং, শিবরাম রাজগুরু এবং শুকদেব থাপার। বিপ্লব? সে তো সবে শুরু হল!

তাঁর ভাই কুলবীর সিং ও কুলতার সিংও পরবর্তীতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে। একাধিকবার অনশন করেছেন জেলের মধ্যে। মা বিদ্যাবতীর সস্নেহ হাত ছিল তাঁদের উপর। এক পুত্র শহীদ, দুই সন্তান জেলে, পরিবারের অন্য সদস্যদের উপরেও নেমে এসেছে চরম অত্যাচার। তখন লাহোরে এক জনসভায় বিদ্যাবতী দেবী বলেছিলেন,
“তোমরা কি ভেবেছ এতে আমি ভয় পেয়েছি? না, আমি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারি কিন্তু কিছুতেই মাথা নত করব না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আমি বলতে চাই, আমার আর যে দুটি পুত্র আছে তাদেরও দেশের সেবায় আমি উৎসর্গ করলাম।”
সেদিন দেশের ঘরে ঘরে ছিলেন এরকম মায়েরা। যারা না থাকলে কোনোদিনই জন্ম হত না ভগৎ সিংদের। 

ঋণস্বীকার :
সন্ত্রাসবাদ ও শহীদ ভগৎ সিং, সন্তোষকুমার অধিকারী
ভগৎ সিং নির্বাচিত বক্তৃতা ও লেখাসমূহ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট
ভগৎ সিং রচনা সংগ্রহ, পত্রলেখা

Powered by Froala Editor